রক্তে কেনা স্বাধীনতা
২৫ মার্চ ২০২৩ ১৬:১৭
একটি দেশের স্বাধীনতার যে কত মূল্য তা বোঝা যায় পরাধীন থাকলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেছে। এই পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে এই বয়সের বাইরে যারা পাকিস্তানি উপনেবৈশিক শাসন বা বৃটিশ শাসনের বেড়াজালে থেকেছেন বা দেখেছেন তারা জানেন স্বাধীনতা ও পরাধীনতা কি? স্বাধীন পরিবেশে বসবাস করে পরাধীন অবস্থার কথা কল্পনাও করা যায় না। স্বাধীনতা আমাদের এক অমূল্য সম্পদ। আর এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। বৃটিশের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামের যে এক অদ্ভুত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারও অনেক ইতিহাস আছে। যা এই স্বল্প পরিসরে বলা বা লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই স্বাধীনতা যে এই অঞ্চলের মানুষের বা বাঙালির প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না তা তারা অতি দ্রুতই বুঝতে শুরু করে।রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ’র মধ্যেও কেউ কেউ অতি দ্রুত বোঝে। যদিও ওই সময়ের প্রায় সকল নেতাই পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই পাকিস্তান যে টিকবে না বা এই স্বাধীনতাই যে এই অঞ্চলের(পূর্ব পাকিস্তানের) মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা না তা সর্বাগ্রে বুঝেছিলেন তৎকালীন সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরই এই অঞ্চলের মানুষকে মাতৃভাষার জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আর পাকিস্তান যে প্রকৃত অর্থে এই অঞ্চলের মানুষের নিজের দেশ ছিল না তা তারা(তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী) শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। পরাধীনতাটা তখনই টের পাওয়া গিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন। যা ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। যা ছিল বাঙালির হাজার বছরের আরাধনার ফসল।
কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও লড়াই সংগ্রামের ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দীর্ঘ চব্বিশ বছর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম জেল-জুলুম খেটে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই দেশটাকে স্বাধীন করতে হয়েছে। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে নেতা তার জীবন যৌবনের চব্বিশটি বছর লড়াই সংগ্রাম করে সাড়ে চৌদ্দ বছর জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে ফাঁসির মঞ্চে থেকে ফিরে এসেছেন এবং তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই যে চব্বিশ বছরের নিরীবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম কত যে মায়ের বুক খালি হয়েছে কত যে নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তা ভুক্তভুগিরাই ভালো জানেন। কত নেতা গাদ্দারী করেছে, কত নেতা যে এই অঞ্চলের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে তার শেষ নাই। কিন্তু একজন মানুষ একজন মহামানব স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে বাংলাদেশের মানুষকে এক সুতায় গেথেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
পৃথিবীর কোন দেশকে হয়তো স্বাধীনতার জন্য এমন চড়া মূল্য দিতে হয়নি। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের সংগ্রাম, শুরুতে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা,তারপর পাকিস্তানি উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, বলা যত সহজ কিন্তু কাজটা করা ছিল অনেক বেশি কঠিন। সচেয়ে কঠিন কাজ ছিল দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে একসাথে করা ঐক্যবদ্ধ করা। এই দুরহ কাজটি সঠিকভাবে করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। তিনি প্রতিটি বাঙালিকে খুব ভালোভাবে চিনতেন,তাদের খুব ভালো বাসতেন। প্রতিটি বাঙালিও তাদের এই নেতাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক একটি মিথ্যা মামলায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার যখন বংগবন্ধু মুজিবকে প্রহসনের বিচারের নামে ফাসিতে ঝোলানোর পায়তারা করছিলো তখন এই বাঙালি ছাত্র জনতা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। শুধু তাই নয় জান্তা শাসক ক্ষমতার গদি ছেড়ে পালিয়ে যায়। যদিও ক্ষমতা দিয়ে যায় আরেক জান্তার কাছে! তারপরের ইতিহাস তো করুন ইতিহাস, ক্ষমতা হস্তান্তর না করার টালবাহানা, সময়ক্ষেপন, তারপর ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম গনহত্যা চালানো। বংগবন্ধু কর্তৃক ২৬ শে মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানের জান্তা সরকার তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশিয় এজেন্ট জামাত-মুসলিম লীগের রাজাকার আলবদর আল শামসের সহায়তায় বাংলাদেশে চালায় নির্মম গণহত্যা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতারা পুরোপুরি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের মোকাবেলার সব রকম প্রস্তুতি গ্রহন করে। মুজিব নগরে বংগবন্ধুকে রাস্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে। বংগবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাস্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে ও বংগবন্ধুর নামে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। যেখানে এই ভুখন্ডের কিছু গাদ্দার ব্যাতিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামরিক,বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারী, শ্রমিক কৃষক,ছাত্র জনতাসহ সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ করে।
নয় মাসব্যাপি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দু লক্ষ মা বোনের চরম আত্নত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যে মানুষটি নিশ্চিত মৃত্যু জেনে নিজেকে বুলেটের সামনে চিতিয়ে দিয়ে দেশ স্বাধিন করে দিয়ে গেছেন তার আত্নত্যাগের কাছে পৃথিবীর অন্যসব ত্যাগ আর সংগ্রাম কিছুই না। বাঙালিকে এমন মন্ত্রেই উজ্জিবিত করেছিলেন তাদের নেতা শেখ মুজিব। নেতার কথায় দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজকের এই স্বাধীনতা, এই বাংলাদেশ। তাদের সেই রক্ত বৃথা যায়নি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যবিত্ত্ব দেশের পথে। মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, রিজার্ভের পরিমান বহুলাংশে বৃদ্ধি ও জিডিপিতে বাংলাদেশ আজ অনেক দেশকেই অতিক্রম করে চলেছে। যমুনা নদীর উপর বংগবন্ধু সেতু,পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল নির্মান এখন বাস্তবতা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে,রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র,পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। শতাধিক ইকোনোমিক জোন, চট্রগ্রাম -কক্সবাজার রেললাইন আর জেলায় জেলায় ফেরির বদলে বড় বড় সেতু এখন বাস্তবতা । বাংলাদেশের জন্মের বেদনা ছিট মহল সমাধান ও সমুদ্রে নিজেদের অধিকার প্ৰতিষ্ঠা শেখ হাসিনা সরকারের বা স্বাধীন দেশের বিরাট অর্জন। খাদ্য ও বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, তথ্য প্রযুক্তিতে স্বপ্নের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া, এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রাথমিকের চার কোটি বই বছরের প্রথম দিনে ছাত্র ছাত্রীদের হাতে তুলে দেয়া। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা, সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় বিধবা ভাতা, বয়স্ক ও স্বামী পরিত্যাক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বিশ হাজার টাকা নির্ধারণ করা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়াসহ নানা ধরণের সামাজিক সুরক্ষামুলক কাজ করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর এগুলোই শহিদদের আত্নত্যাগের স্বার্থকতা।
যে পাকিস্তানের শোষনের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে হয়েছিল সেই পাকিস্তান আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব সংকট মোকাবেলা করে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা এগিয়ে নিতে আরো কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বংগবন্ধুর স্বপ্নের এই দেশে চিরতরে দুর্নীতির মুল উৎপাটন করতে হবে। নিজ দলসহ সকল দুর্নিতিবাজ ঘুষখোরদের নিজ নিজ দল থেকে বের করে দিয়ে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গুড়িয়ে দিতে হবে এবং তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দেশবিরোধী সকল কর্মকান্ড কঠোর ভাবে দমন করতে হবে। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আরো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করে শহিদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যে দেশবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় বসে অপকর্ম শুরু করেছিলো সেই জঞ্জাল প্রায় শেষ করে এনেছেন তার কন্যা। একাত্তর ও পচাত্তরের ঘাতকদের বিচার হয়েছে বা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকাংশে ফিরে এসেছে। একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের বংশধর চিহ্নিত হয়েছে, পচাত্তরের ঘাতকদের লালন পালনকারীরা ইতিমধ্যেই দেশবাসীর কাছে ধরা পরেছে। স্বাধীন দেশের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারী ও জঙিবাজ বোমাবাজ বা আগুন সন্ত্রাসীরা দেশের মানুষের কাছে চিহ্নিত হয়েছে। এতিমের টাকা আত্নসাতকারি ও খুন দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে পলাতক অপরাধীদের দেশবাসী চিনতে পেরেছে। তাই এখন আরো সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলা। কারন এ স্বাধীনতা যে অনেক রক্তে কেনা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীনতা।
লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সারাবাংলা/এসবিডিই