আগুনে পানি ঢালবে কে?
৪ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:৩১
খুব ছোটবেলায় আমাদের পরিবারে ঘটেছিল এক ভয়াবহ বিপর্যয়। যে বিপর্যয় আমাদের দিয়েছিল এক নতুন শিক্ষা। ১৯৯২ সালের কোনো এক রাতে মাত্র ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে আমাদের বাড়ি, ব্যবসাকেন্দ্রসহ যাবতীয় স্থাপনা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মনে পড়ে আমাদের মমতাময়ী মা আমাদের হাত ধরে আগুন থেকে কোনোভাবে আমাদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন। আমরা সবাই এক বস্ত্রে বের হয়ে সেদিন প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি এখনও আমাদের তাড়া করে ফেরে। সেইবার আগুন আমাদের পুরো জীবনকেই পাল্টে দিয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত এমন অগ্নিকাণ্ডের খবর ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত যেতে যেতেই সব কিছু পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে আগুনে পুড়ে সব কিছু ছাই, তখনও ধোঁয়া উড়ছে, সকলেই কান্নাকাটি করছে আর সে সময় ফায়ার সার্ভিস এলো। সেই ছাই চাপা আগুন নেভানো হলো। কয়েকজন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ফায়ার সার্ভিসের সেই তীব্র পানিতে গা ধুয়ে নিচ্ছিল । আমাদের সেইবার আগুন থেকে রক্ষা করেছিলো বা অনেককে বাাঁচিয়েছিল বাড়ির পেছনের পুকুরটি। আমার আব্বাও সেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন।
২.
ঢাকায় আমি যে এলাকায় বসবাস করি গতবছর আমার সেই বাসার গাড়ি পার্কিংয়ের একটি গাড়িতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। আমি তখন অফিসে, আমার জীবনসঙ্গীর ভয়াবহ আতঙ্কিত কণ্ঠের ফোন আমার কানে বাজে এখনও। আমার আব্বা-আম্মাকে নিয়ে ওরা ফ্ল্যাটে আটকা পড়েছে, আগুন আর ধোঁয়ায় তারা বের হতে পারছে না। আমাদের মেয়ের তীব্র কান্নার আওয়াজ আমি অফিসে বসে শুনছিলাম। যা হোক হাউজিং এর দারোয়ানদের তৎপরতায় আমার পরিবারসহ অনেকে বেঁচে গিয়েছিল সেযাত্রায়। পাশের বাসার ছাদ দিয়ে প্রাণ নিয়ে তারা কোনোভাবে বের হতে পেরেছিল। খবর পেয়ে আমি যখন আমার অফিস থেকে অর্ধেক রাস্তা গাড়ি আর অর্ধেক পাগলের মতো দৌড়ে বাসার নিচে পৌঁছেছিলাম তখনও ফায়ার সার্ভিস আসেনি। বস্তুত আসতে পারছিল না। কারণ এই হাউজিং এ ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢোকার মতন রাস্তা নেই। ফায়ার সার্ভিস এসে শেষটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে নেয় আশপাশের বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড স্টোর থেকে পানি নিয়ে। এ এলাকায় কোনো জলাধার অবশিষ্ট নেই।
৩.
২০১৩ সালে তাজরীন গার্মেন্টস-এ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে একটা ছোট গবেষণা কাজে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় অগ্নিকাণ্ডে আহতদের কিছু ইন্টারভিউ করেছিলাম। সে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। যারা পুড়ে মারা গিয়েছিল তাদের কথা নাইবা বললাম কিন্তু যারা ভবনের ছাদ থেকে জলাশয় ভেবে যেখানে লাফ দিয়েছিল সেটি ছিল একটা মৃত্যুফাঁদ। সেখানে কিছু পানি জমেছিল আর পানির নিচে ছিলো ধারাল রড আর ধাতব বস্তু। সেই ডোবাটা সেদিন রক্তে লাল হয়েছিল। সেটিও জলাশয় ছিল না। একটি জলাশয় থাকলে হয়ত সেদিন অনেকেই জীবন রক্ষা হতে পারতো।
আজ সকালে যখন বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবরটা পেলাম, শুরুতে ততটা গুরুতর ভাবিনি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানান নিউজ দেখে খুব অস্থিরতা কাজ করছিল। আবারও মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলার সেই স্মৃতি। দুপুর গড়িয়ে গেলেও ৫০টা ফায়ার সার্ভিস ইউনিটও এই ভয়ঙ্কর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে ডাকা হয়েছে আগুন নেভাতে। পানি নেই বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর থেকে পানি নেওয়া হচ্ছে বলে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল। হাতিরঝিল থেকে বিমান পানি নিয়ে যাচ্ছে এমন ছবিও আমরা দেখেছি। ঢাকা শহরে কিছুদিনের ব্যবধানে মারাত্মক কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল। এ ছাড়া নিমতলী, চুরিহ্ট্টাা, সেজান জুস ফেক্টরি, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের দগদগে স্মৃতি আমাদের চোখে ভাসছে। এ সব অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য মানুষের জীবন গিয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা হারিয়েছে। আজ যেমন মাতম করছেন একজন নারী, তিন ভাই আহাজারি করছেন তাদের সব শেষ হয়ে গেছে বলে। আসছে ঈদ তাদের পরিবার পরিজনের জন্য কি অপেক্ষা করছে, কে জানে?
ঢাকায় যতবার আগুন লেগেছে ততবারই নগর পরিকল্পনায় ত্রুটি, ফায়ার সার্ভিস ও তার সীমাবদ্ধতা, বিল্ডিং ডিজাইন ও জলাধারের সংকটের প্রসঙ্গগুলো উঠে আসলেও এগুলোর বাস্তবিক সমাধানের কোন উদ্যোগ ও তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। ঢাকা শহরের যত জলাশয় ছিল তা এই নগরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আর এখন যে জলাশয়গুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে পরিকল্পনামাফিক। এখন জলাশয় হলো দখল আর দূষণের জায়গা। ঢাকার ১৯টি খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। শহরে কোন অগ্নিকাণ্ড হলে এখন আর পানির কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়না । বুড়িগঙ্গা যেমন মৃতপ্রায় হতে যাচ্ছে একইভাবে খাল ও জলাশয়গুলোও। তাইতো যখনই আগুন লাগে আমরা হা-হুতাশ করি। সেই হা-হুতাশ নীতি নির্ধারকদের কাছে কতটা পৌঁছে সেটাই বড় প্রশ্ন জাতির সামনে।
একটা নগরের পরিকল্পনা কেমন তার কিছু সুস্পষ্ট বিষয় থাকে। আমাদের প্রতিদিনকার অনিরাপদ জীবন বুঝিয়ে দেয় এই নগরের পরিকল্পনার গলদ আর তার অবহেলার কথা। পরিবেশবাদী ও নগরবিদরা কখনও কখনও এ বিষয়টি রাষ্ট্রের নজরে আনলেও তার সুরাহা হয়নি। এত হাজার হাজার কোটি টাকা আর লোকবল কোন কাজেই লাগেনা যেকোন অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হলে। আমাদের মৃতপ্রায় নগরীতে আগুন লাগলে সে আগুনে পানি ঢালার আসলে কেউ নেই। এখানে এক কর্তৃপক্ষ আরেকজনের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত। একটা নগরকে বাসযোগ্য করতে প্রয়োজন শক্তহাতে নিয়ম ও আইনের বাস্তবায়ন। সেটা কোন হাউজিং এর ঢোকার রাস্তা প্রশস্ত করতে যেমন, তেমনি একটি মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও। ফায়ার সার্ভিস, রাজউক কেন এত অসহায় থাকবে? রাজধানীর কোন কোন ভবন অনুমোদনের বাইরে তা কি রাজউক জানে না? আমরা সাধারণত বস্তি উচ্ছেদ ও হকার উচ্ছেদে যেভাবে বুলডোজার ব্যবহার করতে দেখি, সেটা দখলদারদের ক্ষেত্রে কেন হয় না? এই সকল নগর ধ্বংসকারীদের উচ্ছেদ করতে সরকারের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করা জরুরি। তা না হলে এই নগর ধ্বংস হতে থাকবে কিন্তু বাস্তবে কারও কিছু করার থাকবে না।
শেষ কথা
ঢাকাকে একটি বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, ওয়াসাকে নিয়ে সমন্বিত সেল গঠন করে এখনই মাঠে নামার বিকল্প নেই। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার জন্য সরকারকে কঠোর, নিরপেক্ষ ও জিরো টলারেন্স ভূমিকা নিতে হবে। হাজার হাজার ভবন ভাঙ্গার প্রয়োজন পড়লে ভাঙতে হবে। ঢাকার সকল জলাশয়কে দখলমুক্ত করে তার নাব্যতা ফেরাতে হবে দ্রুত সময়ে। অগ্নি নির্বাপক কাজকে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাধ্যতামূলক কাজ হিসেবে নিতে হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের স্বেচ্ছাসেবক ইউনিট হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। সর্বোচ্চ আধুনিক প্রযুক্তি ফায়ার সার্ভিসে সংযুক্ত করতে হবে। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন ও তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের পেশায় ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরী দেখতে চাই।
লেখক: সম্পাদক, পরিবেশ বার্তা ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী