Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মঙ্গল শোভাযাত্রা যৌথ কর্মযোগের এক অনন্য উপমা

কামাল পাশা চৌধুরী
১১ এপ্রিল ২০২৩ ১২:২৮

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালিন চারুকলা ইনস্টিটউটের একদল উৎসাহী শিক্ষার্থীর নেয়া উদ্দ্যোগে শুরু করা ১লা বৈশাখের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ পরবর্তীতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারন করে বাঙ্গালির জাতীয় উৎসব হিসাবে অনেক আগেই গৌরবের সাথে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বলা যায়, আত্মপ্রকাশের পর থেকেই গোটা জাতির নববর্ষ বরণের প্রধান আকর্ষণ ও প্রধান জাতীয় সংবাদ হিসাবে স্থান পেয়ে এসেছে এই শোভাযাত্রা। এর উদ্দেশ্য, দর্শন ও শিল্পরূপ নিয়ে বহুবিধ আলোচনা, প্রসংশা হয়ে এসেছে প্রতিনিয়ত। আমরা তা’ সবই অবগত।

বিজ্ঞাপন

সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ও অংশগ্রহণের পাশাপাশি এ দেশের ধর্মব্যবসায়ী ও উগ্র মৌলবাদী মহলটিও খুব দ্রুতই বুঝে যায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সকল অমঙ্গলের উৎসের মত তাদের জন্যও অমঙ্গলের বীজ বুনে যাবে নিসঃন্দেহে। তাই শুরু থেকেই নানা রকম অপপ্রচার চালিয়ে এর বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মানুষকে সোচ্চার করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা। কিন্তু এক সময়ের তাদের রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ বা ছায়ানটের বটমূলের অনুষ্ঠানের বিরোধীতার মতই সাধারণ মানুষের কাছে তাদের ডাক প্রত্যখ্যাত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্ত ইউনেস্কোর ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অফ ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউমিনিটি’র তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এই অপমহল আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পরাজিত যুদ্ধাপরাধীর এক ধরনের জিঘাংসা ও ক্ষমতারমুখি রাজনীতির নানা উপাচার। এসব যত কিছুই হোক আমরা কিন্তু এ নিয়ে খুব ভাবিনা, এ সব অমঙ্গল কর্মের বিরুদ্ধেই তো আমাদের অভিযাত্রা।

কিন্তু একটা বিষয় উল্লেখ করতেই হচ্ছে, ইউনেস্কোর এই কালচারাল হেরিটেজ ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে শুরু হয়েছে এর ইতিহাস নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষণ। এটাও খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্ত যারা এই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রকৃত উদ্যোক্তা তারা সম্প্রতি খুব উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন রকমের ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরছে। তার মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের তথ্যবিকৃতিও ঘটছে। তাই আমরা যথার্থই শঙ্কা প্রকাশ করছি যে, এ সব ভুল, আংশিক সত্য ও বিকৃত তথ্য ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক আলামত হিসাবে সত্য রূপে গণ্য হবে। তাই এখনই এই আত্মঘাতি প্রকৃয়াটি বন্ধ হওয়া জরুরী বলে আমরা মনে করছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে আরও সচেতন ও দায়িত্ববান হওয়ার জন্যও অনুরোধ করছি।

অতীতেও কিছু ভুল তথ্যসম্বলিত প্রবন্ধ দু’একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দু’একজন বরেণ্য ব্যক্তিও তাদের লিখায় কিছু স্মৃতি বিভ্রাট ঘটিয়েছেন। মূলতঃ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র সূচনার পর থেকে প্রতি বছরই এর সাথে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হয়েছেন চারুকলার নতুন ছাত্র-শিক্ষকসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় সকল বরেণ্য ব্যক্তি ও সংস্কৃতিকর্মীগণ। তারাও অবশ্যই এই মহৎ উদ্দ্যোগের অন্যতম অংশীদার। কিন্ত তাদের অনেকেই নিজের অংশগ্রহণের সময়টাকেই শোভাযাত্রার সূচনাকাল হিসাবে গুলিয়ে ফেলেন। এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির লিখা বা সাক্ষাতকারের বক্তব্য ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র খন্ডিত বা ভুল ইতিহাস তুলে ধরে। তার মাঝে কেউ কেউ নিজের ভুমিকাটাকে বা তার পছন্দের কাউকে অধিক প্রধান্য দিতে গিয়ে সত্য থেকে কিছুটা বিচ্যুতও হয়ে যান।

একটা কথা নির্মল সত্য যে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কোনও ব্যক্তি বিশেষের একক চিন্তার সৃষ্টি নয়। এটি সম্পূর্ণ রূপেই একটি সম্মিলিত ভাবনাবিনিময়ের যৌথ উদ্দ্যোগের ফসল। এবং এই যুথবদ্ধ প্রয়াসের মাঝেই মূলত: নিহিত ছিল সকল প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপকে সফল করে তোলার গোপন প্রাণশক্তি। তবে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ব্যক্তিরই মেধা, সৃজনশীল ভাবনা, ও শ্রম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে যুক্ত হয়েছে এখানে। কারো কিছু বেশি, কারো একটু কম, কিন্তু সবারটাই সমান মূল্যবান উপাদান হিসাবেই গন্য।

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র উৎপত্তি বাংলা-১৩৯৬ সালে (ইংরেজী-১৯৮৯)। শুরুর বছর এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরের বছর ১৯৯০ থেকে এর নাম হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এই নামাকরণটি করেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির দুই দিকপাল ভাষা সৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন আর প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক। শোভাযাত্রার স্বপ্নবীজটা প্রোথিত হয়েছিল মূলতঃ ১৯৮৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মোৎসব পালনের একটি ক্ষুদ্র শোভাযাত্রার আয়োজন থেকে। আগেও বলেছি, সময়টা ছিল তখন রাজনৈতিক সামাজিক দিক থেকে খুবই অস্থির এক সময়। বাঙালি সংস্কৃতি তথা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির উত্থান, সরকারি দমন-পীড়ন, অন্যদিকে উত্থাল ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে চরম নৈরাজ্য। শুভ চেতনা ও মূল্যবোধ গুলো প্রায় অবদমিত। এ সময় চারুকলার ১৯৮৬-৮৭সালের ব্যচের বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী সংঘবদ্ধ ভাবে অংশ নিতে থাকে চারুকলাসহ গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রায় সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, চারুশিল্পী সংসদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, এ রকম যে কোনও সংগঠন যে কর্মসূচি নেয়, এই গ্রুপটিকে দেখা যায় কাজের অগ্রভাগে। মিছিল মিটিং থেকে বন্যা ত্রান, বিজয় দিবসে ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা নির্মান, জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চ তৈরীসহ সকল শুভকর্মেই তারা ছিল অগ্রগামী। এরাই এক সময় চিন্তা করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিনে একটি শোভাযাত্রা করার। সেখানে তারা বাঁশ, কাগজ, বোর্ড, শোলা দিয়ে তৈরী করে কিছু পেঞ্চিল, তুলি, কালার পেলেটের বৃহৎ আকারের প্রতিকৃতি আর কিছু বিচিত্র মুখোশ। এগুলো বহন করে ঢাক ঢোল, খোল করতাল বাজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিন করে একটি ছোট্ট র‍্যালী। এই কাজে তাদের সাথে বেশ কিছু অগ্রজ ও অনুজ ছাত্র-ছাত্রীও অংশ নেয়। এই শোভাযাত্রা ব্যাপক সাড়া ফেলে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। এখান থেকে অনুপ্রানিত হয়েই সবাই ভাবতে থাকে আরও বড় আকারে কিছু একটা করার। শুরু হয় ছোট ছোট বৈঠক। কিছু সিনিয়র জুনিয়রও যোগ দেয় আলোচনায়। পরিকল্পনা রূপ নিতে থাকে বাস্তবে। সিদ্ধান্ত হয় ১লা বৈশাখ বড় আকারের একটি শোভাযাত্রার। শুরু হয় গবেষনা। বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকেও নেয়া হয় নানা পরামর্শ। অনুসন্ধান শুরু হয় অতীত ও বর্তমানের বৈশাখসহ বাঙ্গালির লোকজ অনুষ্ঠানগুলোর, তাদের প্রকৃতির। ধামরাই মানিকগঞ্জের রথযাত্রা, যশোরের ১লা বৈশাখের মিছিল, পুরান ঢাকার ঈদ ও মোহরমের তাজিয়া মিছিল, টাঙ্গাইলের সংযাত্রা, নেত্রকোনার লাম্বাগীত ও কিচ্ছা, উত্তর বঙ্গের শিবের গাজন ও গম্ভীরা, সব কিছু থেকেই উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। নিরিক্ষণ করা হয় বিশ্বের বড় কার্নিভ্যালগুলোর। তার মাঝে ডোমিনিকা কার্নিভ্যাল, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান গ্যালি, ক্যারাবিয়ান টোবাগোসহ ব্রাজিল, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার কার্নিভ্যালগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয় গভীরভাবে। তবে মূল ভিত্তি করা হয় আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে।

বাংলার চারুশিল্পীদের তৈরী কাঠের হাতি, লাম্বাগীতের ঘোড়া, সড়ার পট থেকে নেয়া মোটিফের আলপনায় মুকুট, মুখোশসহ সব উপাত্তই গ্রহণ করা হলো লোকায়ত শিল্প থেকে। শুরু হল কাজ। অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এক সময় পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে রাস্তায় নামে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা আজও চলছে এবং চলবে আপন মহিমায়।

লেখক: উদ্যোক্তাদের একজন ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ।

সারাবাংলা/এসবিডিই

কামাল পাশা চৌধুরী মঙ্গল শোভাযাত্রা এক যৌথ কর্মযোগের অনন্য উপমা মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর