প্রসঙ্গ: বিদ্যানন্দ
১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:২০
একটি গল্প আছে। গল্পটি সবাই জানেন। পাপীদের পরকালে জায়গা হয় দোজখে। সব দোজখেই পাহারাদার থাকে যাতে কোন পাপী পালিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু একটি দোজখে কোন পাহারাদার নেই এবং সেই দোজখ থেকে কেউ পালিয়েও যেতে পারে না। দোজখটি বাঙ্গালিদের জন্য। সেখান থেকে কেউ পালিয়ে যেতে চাইলে আন্যরা টেনে ধরে রাখে । ফলে কেউ পালিয়ে যেতে পারে না। এটি বাঙ্গালিদের চরিত্রের একটি প্রতীকি গল্প। বাস্তবেও আমরা এমন ঘটনা ঘটতে দেখি। কেউ কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাইলে অনেকে এক যোগে যেটিকে নষ্ট করতে উঠে পড়ে লাগে। কেউ ভাল কিছু করতে গেলে দলবেধে অন্যরা সমালোচনায় মেতে উঠে। এই যেমন চলছে এখন বিদ্যানন্দকে নিয়ে। আমাদের চারপাশে কত গরীব মানুষ। কয়জন কতজনকে এক বেলা খাবার দিয়েছি? কিন্তু সেই আমরাই বিদ্যানন্দের উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনায় উচ্চকন্ঠ। একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে কাজ করে। তাদের কাজের স্বচ্ছতা আছে কিনা এগুলো যাচাই না করেই নিজের কাল্পনিক ধারণা থেকে কেউ বা কয়েকজন কিছু বলার বা সন্দেহ করার পরই সবাই তা নিয়ে মেতে উঠেন এবং প্রতিষ্ঠানটিকে বা ব্যক্তিকে বা উদ্যোগটিকে ধসিয়ে দিয়ে মহাসাফল্যের ঢেকুর তুলেন।
বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে বর্তমান সমালোচনা, অভিযোগের ঝড়ের ক্ষেত্রে নিজস্ব কৌতুহল থেকে বক্তিগভাবে কিছু জানার চেষ্টা করে নিশ্চিত হচ্ছি দেশের ভাল মানুষরা আরেকটি ভাল উদ্যোগকে ধ্বংস করার জোর চেষ্টায় আছেন। এমন পরিস্থিতে প্রতিষ্ঠানটি হয়তো বন্ধ করেও দিতে পারেন উদ্যোক্তারা। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে আর কত আক্রমণের শিকার হতে যাবেন তারা? আফসোস এরপর এই দেশে আর কেউই হয়তো ভাল কোন উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হবেন না।
১) ছবির কোলাজ
ছবির একটি কোলাজ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। সেই কোলাজে অন্য একজনের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বিদ্যানন্দ ভুল স্বীকার করে সেই ভুলের ব্যাখ্যা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে ছবির আর্টিস্টের কাছে। এটি উদ্যেশ্য প্রণোদিত কোন ভুল বা অপরাধ নয়।
২) মজিদ মিয়াকে নিয়ে ট্রল
মজিদ মিয়া বিদ্যানন্দের প্রচারণার একটি প্রতীকি চরিত্র। নানা ষ্টোরিতে মজিদ মিয়া, আমেনা খালা, সেলিম, জলিল চাচা এই প্রতীকি ক্যারেকটরগুলো ব্যবহার করা হয়। এরা নির্দিষ্ট ব্যক্তি নন। এসব ক্যারেকটার বঞ্চিত মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে। এ কারণেই বার বার এদের নাম আসে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেখানে বার বার এই নামগুলো আসে সেখানে একই ছবি বার বার আসে না।
বিদ্যানন্দ দুই ভাবে তাদের প্রচারণা চালায়। একটি ইভেন্টের তথ্য ভিত্তিক। মানে কোথাও কোন ইভেন্ট হলে যেমন এক টাকার খাবার দেয়া হলো সেখানে ঐ ইভেন্টের ছবিই ব্যবহার করা হয় তাদের পোস্টে।
আবার আরেক ধরণের প্রচারণা হলো উদ্দীপণামূলক স্টোরি। মানুষকে উজ্জীবিত করতে এই ষ্টোরিগুলো পোষ্ট করা হয়। এই ষ্টোরিগুলোতে পুরনো ছবি ব্যবহার করা হয় এবং সেখানে সেই মজিদ মিয়ার মতো প্রতীকি চরিত্র ব্যবহার করে গল্প বলা হয়। এই ব্যাপারটি বুঝতে না পারার কারণে মনে হয় কুমিরের একই বাচ্চা বার বার দেখানো হচ্ছে। এক মজিদ মিয়া ১১ জায়গায় বিদ্যানন্দের খাবার খাচ্ছে।
৩) একই গরু, ছাগল বার বার
এ ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। বিদ্যানন্দ তাদের প্রতিটি পোস্টে ছবি ব্যবহার করে। যখন তারা একটি গরু কিনে আনে তখন তারা পোষ্টে সেই গরুর ছবি দিয়ে ঘটনা বলে। আবার যখন এই গরুর মাংসে কতজনকে খাওয়ানো হলো সে তথ্যের পোস্টেও হয়তো সেই গরুর ছবি দেয়। আবার নতুন গরু কিনতে যাওয়ার পোস্ট দেয়া হয় তখন কোন ছবি দিবে? গরুতো কেনা হয়নি। তখন দেয়া হয় পুরনো গরুর ছবি। ফলে একই গরুর ছবি হয়তো বার বার তাদের পোষ্টে দেখা যেতে পারে। পোস্টগুলোর পার্থক্যগুলো বুঝতে পারলে খুব খারাপ লোক না হলে এ ধরণের ট্রল কেউ করবে না।
৪) এক টাকার আহার
এটি বিদ্যানন্দের ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট। তবে বিদ্যানন্দের খাবার দেয়ার নানান ক্যাটাগরি রয়েছে। দাতা যে কারণে দান করেন তারা সে ক্ষেত্রেই সে খাবার দেয়। যেমন কেউ যদি তার মা-বাবার জন্য গরীবকে খাওয়াতে টাকা দেন তবে সেই খাবারে কোন টাকা নেয়া হয়না। এমনি ভাবে ইফতারি সেহরির মতো ধর্মীয় ব্যাপরের জন্য কোন টাকা নেয়া হয় না। বিদ্যানন্দ ৫০০ শিশুর এতিমখানা চালায় সেখানে প্রতিদিন যে ১৫০০ খাবার দেয়া হয় তাতেও কোন টাকা নেয়া হয় না। ডোনাররা যে ক্ষেত্রের জন্য যে টাকা দেন তা সে ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। এজন্য স্ব স্ব খাতের ডোনেশন ও খরচের আলাদা হিসেব রাখা হয়।
গরীবদের খাবারের জন্য নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যে ডোনেশন দেয়া হয় সে খাবারে এক টাকা করে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রও টাকা উঠে ৮০%। অনেকেই এক টাকাও দিতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ভলেন্টিয়াররা বাকী ২০% দিয়ে দেয়। এই এক টাকার খাবারের দান ও ব্যয়েরও আলাদা আলাদা হিসাব থাকে। অডিট ফার্ম এই হিসাবগুলো মিলিয়ে দেখে রিপোর্ট দেয়।
৫) ডোনেশন
বিদ্যানন্দ ডোনেশনের কোন টাকা সরাসরি নেয় না। ব্যাংক একাউন্ট বা বিকাশ একাউন্টে টাকা নেয়া হয়। অডিট ফার্ম ব্যাংক থেকেই হিসাব নেয় আর বিকাশের মেসেজ ও স্টেটমেন্ট অডিট ফার্মকে দেয়া হয় তারা সেগুলো নীরিক্ষণ করে।
বিদেশী ডোনেশনও নেয় বিদ্যানন্দ। সেটিও আসে প্রপার চ্যানেলে এবং এনজিও ব্যুরোর ক্লিয়ারেন্সের পর ছাড় করা হয়। এই ডোনেশন ও ব্যয়ের হিসাবও অডিট হয়।
৬) শত শত বিঘা কেনা জমি
বিদ্যানন্দ শত শত বিঘা জমি কিনেছে এমন কথা ভাইরাল হয়েছে। বিদ্যানন্দ চারটি দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ১৩০ বিঘার মতো জমি লিজ নিয়েছে। জমিগুলো বিদ্যানন্দকে ডেকে নিয়ে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য স্থানীয়রা লিজ দিয়েছে। এগুলোতে বিদ্যানন্দ এতিমখানা ও স্কুল চালায়। লিজ ডিডে লিখিত শর্ত আছে যতদিন বিদ্যানন্দ সমাজকল্যাণমূলক কাজ চালাবে ততদিন তারা এই জমি ব্যবহার করতে পারবে। কাজ বন্ধ করে দিলে এ জমি আর বিদ্যানন্দের এখতিয়ারে থাকবে না। আরেকটি শর্ত এই লিজের জমি অনাথালয়, শিক্ষালয় ছাড়া পর্যটন,বাণিজ্যিক বা অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। এ জমি বিদ্যানন্দের সম্পদ নয়। এজন্য তাদের সম্পদ বিবরণীতে এই জমির উল্লেখ নেই। তাদের তিনটি কেনা জমি আছে। একটি রামুতে যেখানে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সন্তানদের এতিমখানা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে একটি জমি আছে। চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংয়ে বিদ্যানন্দ একটি হাসপাতাল চালায়। সেই বিল্ডিং ছেড়ে দিতে হলে যেন তারা হাসপাতালটি চালিয়ে যেতে পারে সে জন্য ৫ কাঠার একটা জমি কেনা হয়েছে। আরেকটি জমি আছে কুড়িগ্রামে ১ একর ১০ শতাংশের। যেটিতে মহিলা এতিমখানার জন্য ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া বিদ্যানন্দের উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের পরিবার তাদের নিজস্ব জমি দান করেছেন এবং ঢাকায় ধানমন্ডির একজন দাতা বিদ্যানন্দকে জমি দান করেছেন।
৭) বিদ্যানন্দের লেনদেনের অডিট
বিদ্যানন্দ প্রতিবছরই একটি খ্যাতিমান অডিট ফার্মকে (হাও্লাদার এন্ড কোং/একনাবিন/ মোসা মোহিত অডিট ফার্ম) দিয়ে তাদের প্রাপ্ত ডোনেশন ও ব্যয়, লেনদেনের এবং ভ্যাট-ট্যাক্সের অডিট করায়। সে অডিট রিপোর্ট সবার জন্য উন্মুক্ত। তাদের ওয়েব সাইটে ঢুকে যে কেউ সেটি দেখতে পারেন। একাউন্টের ইয়ার ক্লোজিং অ্যামাউন্ট এবং টোটাল অ্যামাউন্ট নিয়ে ধারণা নেই বা যারা এ দুটোর পার্থক্য বুঝতে পারেন না এবং অডিট রিপোর্টে কোথায় আছে তা বের করতে পারেন না তারাও অডিট রিপোর্ট নিয়ে মন্তব্য করছেন।
৮) বিদ্যানন্দের প্রচারণা
এ নিয়েও অভিযোগ। আসলে বিদ্যানন্দ টাকার বিনিময়ে কি কোন বিজ্ঞাপন দেয়? তারা সোস্যাল মিডিয়ায় তাদের ৭-৮টি পেইজে নানা ধরণের পোস্ট দেয়। তথ্য দেয়। ঘটনা বলে। অনুভুতি প্রকাশ করে। এটি তো আমরা সবাই করি। এতে অন্যায় কোথায়। ভাল লাগলে অন্যরা সেটি শেয়ার করে। বিদ্যানন্দের এক মিলিয়নের উপর ফলোয়ার। ফলে তাদের পোস্টগুলো অনেকবেশি শেয়ার হয়। সবার চোখে পড়ে।
আমি অন্যের রব শুণে রা রা করতে চাই না। সে জন্য ডেসটিনির সময় যা করেছিলাম এবার বিদ্যানন্দের ক্ষেত্রেও তাই করেছি। জানার চেষ্টা করেছি কি ভাবে কাজ করে তারা। কিভাবে লেনদেন হয়। হিসাব নিকাষ কিভাবে রাখা হয় – এসব জানা ও বুঝার চেষ্টা করেছি। অন্য কারোর আগ্রহ থাকলে তিনিও করতে পারেন। তবে নিজে নিশ্চিত না হয়ে অন্যের কথায় একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়ার বিপ্লবে শামিল হওয়া বোধহয় ঠিক নয়। বিদ্যানন্দের কর্তারা বলেছেন কেউ যদি তাদের কোন অনৈতিক কাজের প্রমাণ পান তাহলে মামলা করুন। তারা সততার সঙ্গেই মানব কল্যাণের জন্য কাজ করেন। বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস বলেছেন “আপনারা আংশিক জেনে, না জেনে এই প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করছেন। আমরা এভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছি।“তিনি আরো বলেছেন আপনারা যদি কাজ করতে না দেন আমরা কাজ করবো না। অন্য যারা আমাদের কাজ বন্ধ করার ব্যবস্থা করে নিজেরা কাজ করতে চান তাদের প্রতি আমাদের কোন ক্ষোভ নেই। আপনারা কাজ করুন। আমরা কাউকে হিংসা করি না।”
হ্যাঁ একটি ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে একই ধরণের কাজ করতে পারে অন্য আরো প্রতিষ্ঠান। সে ক্ষেত্রে ভাল কাজ, মন্দ কাজ কারা করছে সে পার্থক্য বুঝা দরকার। অকারণে কিংবা হিংসায় কিংবা নিজেদের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য নিয়ে যারা মিথ্যা কাল্পনিক তথ্য ছড়ায় তাদের সাথে নিশ্চিত না হয়ে বা না জেনে বিপ্লবী হয়ে একটি ভাল উদ্যোগ, এটি ভাল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া খুবই অন্যায়।
আমি,আপনি, আমরা যদি নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, নিজেদের গ্রামের, নিজেদের পাড়ার দুস্থ পরিবারগুলোকে বা বেকার ছেলেমেয়েদরকে কাজ পেতে, স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করি, চারপাশের দরিদ্রদের যদি সহায়তা করি তবে তো বিদ্যানন্দ বা ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ কারোর নেয়ার দরকার হয় না। আর যদি আমরা সে কাজটি না করি বা করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য না থাকে তবে যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করছে তারা তাদের কাজটি করুক। যাদের ইচ্ছা তারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। আমার ভাল না লাগলে দুরে থাকি। বাধা কেন দিই? ধ্বংসের চেষ্টা কেন চালাই?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই