Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেমন হলো ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’

সোহরাব শান্ত
৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:১১

ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো বিনোদনমূলক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। নাটক, ঈদ আড্ডা, গান, কৌতুক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান- নানা আয়োজন থাকে ঈদের সাত থেকে ১০ দিনজুড়ে।

বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের বিনোদন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় প্রচারিত ইত্যাদি সব শ্রেণির দর্শকের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে অনেক বছর ধরে। দেশে ও প্রবাসে বাঙালিদের কাছে তিন দশক ধরে প্রিয় নাম এই ‘ইত্যাদি’। যদিও সম্প্রতি প্রচারিত ইত্যাদি’র নাটিকাগুলো অতি ভাঁড়ামিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। ইত্যাদি তার আকর্ষণ ধরে রাখতে পিছিয়ে পড়ছে নাকি যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে এ নিয়ে আলাপ উঠতে পারে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘ইত্যাদি’ ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে। বছরের পর বছর ‘ইত্যাদি’ আমাদের বিনোদন যুগিয়েছে। শুধু বিনোদনই নয়, পথও দেখিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শাইখ সিরাজের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় প্রচারিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ আরেকটি বিপুল জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সব শ্রেণির দর্শক নির্মল বিনোদনের এ টিভি অনুষ্ঠান দেখে থাকে। নানা পেশায় যুক্ত দেশের ও প্রবাসী বাঙালিরা শেকড়ের প্রতি টান অনুভব করে। ফলে শুধু কৃষকরাই নয়, পেশাজীবীরাও ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ দেখে সমান আগ্রহ নিয়ে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ঈদের ‘ইত্যাদি’ ও ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ দেখতে অপেক্ষায় থাকি। টেলিভিশনে দেখতে না পারলেও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এ যুগে ইউটিউবে দেখে নিতে ভুল করি না। এবার দেখেছি, মন ভরে গেছে।

এবারের ঈদুর ফিতরের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ নিয়ে বাড়তি আগ্রহ ছিল। কারণ এই পর্বের ধারণ করা হয়েছে আমার নিজজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, নাসিরনগর উপজেলার হাওরাঞ্চলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অনুষ্ঠানের ধারণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম উত্তেজনা। তিনচারদিনে অনুষ্ঠানটি ধারন সম্পন্ন করা হয়েছে। বিপুল কর্মজজ্ঞ ছিল। এ বিষয়ে অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করছিল। বিভিন্ন গ্রামের নানা বয়সী নারী-পুরুষ ভিড় করেছিল অনুষ্ঠানস্থলে- লঙ্গন নদীর পাড়ে খোলা মাঠে।

বিজ্ঞাপন

কৃষকসহ সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও ছুটে গিয়েছি অনুষ্ঠানস্থলে, তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের লোকই বেশি। সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান নির্মাণে সহযোগিতার মনোভাব ছিল স্পষ্ট। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি প্রকল্প নিয়ে শাইখ সিরাজের নির্মিত অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ তখন সদ্যই প্রচার হয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ উৎফুল্ল ছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য বিএম ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম নিজে সারাক্ষণ উপস্থিত থেকে ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ সুন্দরভাবে ধারণে সহযোগিতা করেছেন। কথা বলে জেনেছি- ২০১৬ সালের দুঃখজনক ঘটনার জেরে অসাম্প্রদায়িক নাসিরনগরের হারানো গৌরব ফেরানো ও প্রকৃত রূপ তুলে ধরতে এতটা আগ্রহ নিয়ে সহযোগিতা করেছেন এমপি।

অনুষ্ঠান ধারণের মাঠটি ‘টেকানগর মাঠ’ হিসেবে পরিচিত। ছেলেবেলায় আন্তঃস্কুল ও আন্তঃগ্রাম ক্রিকেট ম্যাচের অনেকগুলোই হতে দেখেছি ওই মাঠে। ফুটবল ম্যাচ তো হরহামেশাই হতো। মাঠের উত্তর পাশে ধনুকের মতো বাঁকা ‘লঙ্গন’, নদীর উত্তর পাড়ে বিশাল হাওর। শুকনো মৌসুমে সবুজ ধানক্ষেত, একসময় পেকে সোনালী রঙ ধারণ করে। বর্ষার হাওর মানে অথৈ জলরাশি। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, হবিগঞ্জের লাখাই আর কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার গ্রামগুলো ভেসে থাকে দ্বীপের মতো। মিঠাপানির মাছের বড় উৎস এসব নদী ও হাওর। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির নাসিরনগরের কৃষকদের নিয়ে শাইখ সিরাজ অনুষ্ঠান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় খুশি হয়েছিলাম।

ঈদের পরদিন প্রচারিত এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। বিশাল মাঠে ধারণ করা এ অনুষ্ঠানে দর্শক উপস্থিতি ছিল স্মরণকালে যেকোনো ‘কষৃকের ঈদ আনন্দের’ চেয়ে বেশি। ‘বালিশ খেলা’, ‘কলাগাছ বেয়ে ওঠা’-এর মতো গতানুগতিক পর্বের ছাড়াও এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দে’ কয়েকটি নতুন খেলা বা প্রতিযোগিতা খুবই আনন্দ দিয়েছে দর্শকদের। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের ‘বউ সাজানো’, নারীদের ‘পিঠা বানানো’, কিশোরদের ‘দ্রুত সময়ে বাইসাইকেল চালানো‘ ও শিশুদের ‘ভালুক দৌড়’ নির্মল আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (ইউপি চেয়ারম্যান) ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে আয়োজিত ‘বউ সাজানো’ পর্ব দেখে সরাসরি ও টেলিভিশন পর্দার দর্শকরা হেসে কুটিকুটি হয়েছে। অল্প সময়ে পিঠা বানানোর পর্বে অংশ নেওয়া নারীরা তাদের দক্ষতা দেখিয়েছে, তারা যেন গ্রামবাংলার চিরায়ত নারীদের প্রতিচ্ছবি।

এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত একাধিক তথ্যচিত্র বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের নদী পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে বানানো প্রতিটি তথ্যচিত্র মুগ্ধ করেছে আমাকে। নদী, খাল, নৌকা, মাছ ধরা, হাস পালন, সাঁতরে নদী পার হওয়া গরুর পাল, নদীতে দুরন্তপনায় মেতে ওঠা শিশু- এ যেন বাংলার আদি রূপ। ক্যামেরার ফে্রেমে ধরা পরা বৈদ্যুতিক খুটিগুলো ছাড়া সবই যেন রয়েছে আগের মতো, ঠিক যেমন দেখেছি ছেলেবেলায়। নেদারল্যান্ডসের জলেভাসা গ্রাম ‘খিটহর্ন’ নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রও মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।

অবশ্য নদীতে ধারণ করা কিছু দৃশ্যে খটকা লেগেছে, তিতাস নদী নাকি লঙ্গনের দৃশ্য? উপস্থাপক বারবার তিতাসের নাম নিলেও অনেক দৃশ্য ছিল লঙ্গন নদীর। লঙ্গন নদীর পাড়ে ধারণ করা কৃষকের ঈদ আনন্দে এ নদীর নাম সেভাবে আসেইনি!

সামান্য এই খটকাটুকু বাদ দিলে এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ অতি চমৎকার হয়েছে। এজন্য খ্যাতিমান কৃষি সাংবাদিক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শাইখ সিরাজকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তার কাছে এ দেশের কৃষকদের প্রত্যাশা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তিনি আমৃত্যু সুস্থ থেকে কৃষকের কল্যাণে কাজ করে যান- এই কামনা করি। এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক নাসিরনগর তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তুলে ধরার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ স্থানীয় সংসদ সদস্য বিএম ফরহাদ হোসেন সংগ্রামকে, যিনি নিজে উপস্থিত থেকে টানা কয়েকদিনের দৃশ্যধারণে সহযোগিতা করেছেন। নিজের কর্মী বাহিনীকে উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা রেখেছেন একটি সফল অনুষ্ঠান নির্মাণে। ফেসবুকের কল্যাণে জেনেছি ‘কৃষকের ঈদ আনন্দের’ দৃশ্য ধারণের সময়ের বাইরেও টেকানগর মাঠ জমজমাট ছিল। হয়েছিল বাউলগানের আসর। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি প্রকল্প নিয়ে নির্মিত অনুষ্ঠানটিও বড় পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। টেলিভিশন দর্শকরা স্পষ্ট না হলেও আমি কণ্ঠ শুনে ঠিকই বুঝতে পেরেছি গভীর রাতে অন্ধকার নদীতে মাছ ধরার দৃশ্য ধারণের সময় শাইখ সিরাজের সঙ্গে ছিলেন সংসদ সদস্য বিএম ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। ‘কলাগাছ বেয়ে ওঠা’ প্রতিযোগিতার বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার আগে শাইখ সিরাজ যথার্থই বলেছেন- বাংলাদেশে আর কোনো সংসদ সদস্যের নাম সংগ্রাম নেই। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার নাম রেখেছেন, সেই সংগ্রামই তো চালিয়ে যাবেন নিজ এলাকা তথা দেশকে এগিয়ে রাখার চেষ্টা।

‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য এক বিনোদন ও তথবহুল টিভি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আগামী পর্ব দেখার দীর্ঘ অপেক্ষা করতে রাজি আছি। শাইখ সিরাজের হাত ধরে আরও কয়েক দশক ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ টিকে থাকুক- এই প্রতাশ্যা করছি।

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার

সারাবাংলা/এজেডএস

কৃষকের ঈদ আনন্দ সোহরাব শান্ত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর