Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অসম্ভবকে সম্ভব করেছে বিদ্যানন্দ

তাপস হালদার
৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৪২

ভালো কাজের জন্য বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। যেখানেই মানবিক সমস্যা সেখানেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে বিদ্যানন্দ সংগঠন। ভালো কাছে বাধা আসবেই, এটা চিরাচরিত সত্য। ফাউন্ডেশনটি সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এটি নিয়মিত অডিট হয়, সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়। যেসব ব্যক্তির অনুদানে প্রতিষ্ঠানটি চলে তারা কেউ কোনদিন কোনো ধরণের অভিযোগ করেননি, করেছে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে এবারই প্রথম বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা নয়। এর আগে ‘বিদ্যানন্দ’ নাম কিংবা প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাসের ধর্ম পরিচয় নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করা হযেছিল। ২০১৭ সালে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অভিযোগ করে বিদ্যানন্দ একটি হিন্দু সংগঠন। সেসময় ইফতার ও সেহরি বিতরণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ করতে ফেক ফেসবুক আইডি থেকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালায়। তখন বিদ্যানন্দ থেকে জানানো হয়, তারা সম্পূর্ণ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সেখানে সব ধর্মের স্বেচ্ছাসেবক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব ধর্মের শিশুদের মানবিক ও শিক্ষা সহায়ক কল্যাণ কার্যক্রমে শ্রম দান করেন।

বিজ্ঞাপন

এবার ফেসবুকে একটি কোলাজ ছবি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। যে মজিদ চাচার নাম নিয়ে বিতর্কের শুরু সেখানে প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে, মজিদ চাচা একক ব্যক্তি নয়, একটি রূপক বা প্রতীকী চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সমালোচনা নিয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস ফেসবুকে লাইফে এসে বলেছেন, যাঁরা বিদ্যানন্দকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তারা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই করছেন। তারা ভাবছেন, বিদ্যানন্দ ভুল করলে তা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে বিদ্যানন্দের কাজ কর্মে কেউ স্বচ্ছতা না পেলে বা প্রতিষ্ঠানটি অনৈতিক কাজ করছে, এমন মনে করলে যে কেউ বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। তাছাড়া এ ভুলের জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে তিনি এর জন্য নিজেকে দায়ী এবং এ অপরাধে পদ ছাড়তে বললে তাতে তার আপত্তি নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ’ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার ইতিহাস বাংলাদেশে খুব কমই আছে, সেক্ষেত্রেও কিশোর কুমার দাস অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

আমাদের দেশে এক শ্রেণীর মৌলবাদী লোক আছে যারা ভিন্ন মতের কেউ হলেই তাদের কাজকে ফতোয়া দিয়ে থাকে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের নাম ও তার ধর্ম নিয়ে কটুক্তিকারী বিষয়ে কিশোর কুমার বলেছেন, ‘বিদ্যানন্দ অর্থাৎ আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন। অনেকেই এটিকে ব্যক্তির নাম ভেবে ভুল করে থাকেন। এই নামকরণও করেছেন একজন মুসলিম এক্সপার্ট। আর জন্মগতভাবে হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে। আমার ধর্ম নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে। মৃত্যু নিয়ে কেউ যাতে কাটাছেঁড়া করতে না পারে, লাশ নিয়ে যাতে কেউ না বলে এটা কোন ধর্মের, তাই বাংলাদেশ থেকে আসার আগে দেহদান করে দিয়ে এসেছি। ’

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক পাশ করা কিশোর কুমার দাস বর্তমানে পেরুতে স্ত্রী জ্যাসিকা মারিয়াকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওলো’তে কর্মরত আছেন। তিনি ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে ‘পড়বো, খেলবো, শিখবো’ স্লোগানকে ধারণ করে তিনি সম্পূর্ণ নিজের টাকায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু করেন। তিনি নিজে সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিকূলতার মধ্যে বড় হয়েছেন বলেই সে তাগিদ থেকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করার প্রেরণা পেয়েছেন। মাত্র দশ বছরে এটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এক টাকায় খাবার, চিকিৎসা, কিংবা পোষাক পাওয়া যাবে-এমন কথা কেউ বললে কি বিশ্বাস করতো?মানুষ তো শুনলেই অবাক হতেন। কিন্তু সেই অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। ছোট বেলা ক্ষুধার সাথে লড়াই করা মানুষটি স্বপ্ন দেখেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার।

বর্তমানে তারা বছরে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষকে রান্না করা খাবার এবং প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে শুকনো খাবারের সহায়তা দিচ্ছে। সাতটি এতিমখানা, পাঁচটি শিখন কেন্দ্র, দুইটি স্কুল, একটি হাসপাতাল ও দুইটি লাইব্রেরি আছে। প্রতিষ্ঠানটির দেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি শাখা আছে। ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীকে নিয়মিত সহায়তা করছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চলমান প্রকল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়া, কুড়িগ্রামে এক টাকায় ভাত-ডাল ও মাছ-মাংসের রেস্তোরাঁ চালু, ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক কড়াইয়ে একসঙ্গে পাঁচ হাজার মানুষের রান্না করার মেগা কিচেন, অবহেলিত উপকূলীয় ও চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘জীবন খেয়া’ নামের ভাসমান হাসপাতাল চালু, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শেষ হওয়ার পর পরিত্যক্ত পতাকা দিয়ে বাচ্চাদের পোষাক বানানো, ভোটের পর পোস্টার দিয়ে বাচ্চাদের খাতা বানানো, একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে প্লাস্টিক মুক্ত করতে প্রতি মাসে দুই বার প্লাস্টিক একচেঞ্জ অর্থাৎ মানুষ প্লাস্টিক জমা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিতে পারবেন, চট্টগ্রামে মা-শিশু হাসপাতাল, ঢাকার মিরপুরে মহিলা কর্মজীবীদের জন্য ‘বাসন্তী নিবাস’, হ্যাপিনেস সেন্টার, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী করোনা কালে নিজেদের তৈরি মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ, হাসপাতালের আশে পাশে ও গণপরিবহনে জীবাণুনাশক স্প্রে করা, হোম কোয়ারান্টাইনের মানুষ ও ছিন্নমূল মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছে সংগঠনটি। এ ধরণের ব্যতিক্রমধর্মী বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও নজর কেড়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত থেকে এবছর একুশে পদক গ্রহণ করেছেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস।

এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একুশে পদক ছাড়াও কমনওয়েলথ পয়েন্টস অফ লাইট পুরস্কার, শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলেন্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় মানব কল্যান পদক, টোকিও ওমেন্স ক্লাব অ্যাওয়ার্ড সহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছে।

একুশে পদক পাওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাস বলেছেন, ‘আমি উদ্যোক্তা হলেও এই প্রতিষ্ঠানে সারা দেশের মানুষ অনুদান দেয়। আর অনেকে নিঃস্বার্থ ভাবে শ্রম ও মেধা দেয়। পদক প্রাপ্তির আনন্দ তাদের স্পর্শ করলে এই স্বীকৃতি সার্থক হবে। মানুষের জন্য কাজ করার জন্যই পদক দেওয়া হয়েছে। তাই মানুষের কাজের মধ্যেই থাকতে চাই। যে মানুষ গুলো দিনের পর দিন নানা কটুক্তি আর সমালোচনা সহ্য করে কাজ করে গেছে গরিবের জন্য, যে মানুষগুলো মাসের শুরুতে আয়ের একটি অংশ পাঠিয়ে দিয়েছেন গরীব মানুষের জন্য, সে মানুষগুলোর কাজ আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকার বিদ্যানন্দকে নয়, মানুষের ভালো কাজ গুলোকেই সন্মানিত করেছেন। ’সত্যি ভালো কাজে সমালোচনা থাকবে, কটুকথা সহ্য করতে হবে কিন্তু থেমে থাকলে চলবেনা। কিশোর কুমার দাসের জীবনকাহিনী যারা জানেন, তারা বিশ্বাস করবেন তিনি থেমে যাওয়ার পাত্র নন। বিদ্যানন্দ সম্পর্কে জানুন, তারপর সমালোচনা করুণ। একসময় যেকাজ গুলো অসম্ভব মনে হয়েছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সেই সব কাজ গুলোকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আসুন বিদ্যানন্দের পাশে দাঁড়াই, সকল অপশক্তিকে রুখে দেই।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এজেডএস

তাপস হালদার বিদ্যানন্দ

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর