Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেন খুন হলেন মুক্তি?

রাজন ভট্টাচার্য
৫ মে ২০২৩ ১৭:৩৩

বখাটের দায়ের কোপে নেত্রকোণার বারহাট্টায় স্কুল শিক্ষার্থী মুক্তি বর্মণ হত্যার ২৪ ঘন্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে ১৯ বছর বয়সী আসামী কাওসার। গ্রেফতারের পর খুনীর ছবি ও ভিডিও দেখে মনে হয়েছে তারমধ্যে কোন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অনুসূচনার বালাই নেই। অনেকটাই স্বাভাবিক। থানায় নেয়ার আগেই প্রাণ খোলে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছে।

দরিদ্র পরিবারের ছয় বোনের একজন ছিল দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মুক্তি। বাল্য বিবাহ ও ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সরব ছিল তার কণ্ঠস্বর। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা পরিবারে জানাজানি হওয়ায় সংক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে কাওসার।

বিজ্ঞাপন

কথা হলো এই বয়সের একটি যুবক মানুষ হত্যা করার মতো সাহস করেছে! এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে। সমাজে এই ঘটনা আসলে কিসের আলামত? হত্যার বিচারের দাবির পাশাপাশি এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও সমাধানের গুরুত্ব কোন অবস্থাতেই কম হতে পারে না।

সভ্য সমাজে এই বয়সের একটি যুবক মানুষ হত্যা করতে পারে বিষয়টি কল্পনা করলেই তো গা শিহরে ওঠার অবস্থা তৈরী হয়। যার এখন পুরোপুরি বড় হওয়া, আলোকিত মানুষ হওয়ার যুদ্ধে থাকার কথা- তার বিরুদ্ধে এখন হত্যার অভিযোগ। কলুষিত সমাজের এর চেয়ে বড় ও নির্মম আর কোন উদাহরণ হতে পারে না। কেন এই যুবক মানুষ হত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়েছে? কেন এমন মানসিকতা অল্প বয়েসে তৈরী হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আগে বের করতে হবে।

শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা ও সভ্যতা বিবেচনায় সমৃদ্ধ দেশগুলো অনেক এগিয়ে। সেখানের সমাজে এ ধরণের ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। তারপর স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে প্রকৃত বিষয় বের করে এনে কার্যকর দাওয়াই নিশ্চিত করে। অর্থাৎ এ ধরণের দু’একটি ঘটনাকে কোন ভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে সেসব দেশ বিবেচনা করে না। এরকম একটি ঘটনাই রাষ্ট্রের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো; যে কারণে এই ঘটনা ঘটেছে, সমাজে অন্যদের মধ্যেও যদি এর প্রভাব পড়ে? অথবা আর কজন এ ধরণের ভয়ঙ্কর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তাই তাদের চিহ্নিত করে কাউন্সিলিং সহ সব ধরণের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

যার ধারে কাছে আমরা নেই। মুক্তি হত্যাকারীর ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা দরকার তা হলো, নাবালক, গাগল, প্রতিবন্ধী বলে তাকে বাঁচিয়ে দেয়ার চিন্তা যেন কারো মাথায় না আসে। এসব রক্ষাকবচ ব্যবহারে তাকে পার করে দেয়ার মানেই হলো, হিংস্র হত্যাকারীকে সমাজে লালন পালনের সুযোগ করে দেয়া। সে ভবিষ্যতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠতে পারে। এরকম আরো জীবন নিতে তার হাত কেঁপে ওঠার কথা নয়। তাছাড়া সমাজের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো ‘প্রভাব’ হত্যাকারী বা অপরাধীর পক্ষ নেয়।

যদি কাওছারের আতœীয় বা পরিচিতজনদের মধ্যে কেউ রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী থেকে থাকে তাদের উচিত আইনকে স্বাভাবিক নিয়মে চলার সুযোগ করে দেয়া। কোন অবস্থাতেই বিচারকে প্রভাবিত করে খুনিকে রক্ষা ঠিক হবে না। এতে রক্ষাকারীরাও একদিন বিপদের সম্মুখিন যেমন হতে পারে, তেমনি তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটনা ঘটে?

কাওছার বেপরোয়া হয়ে ওঠার দায় পরিবার, সমাজ, রাজনীতি তথা রাষ্ট্র কোনভাবেই এড়াতে পারে না। সমাজ ও রাজনীতির নেতিবাচক নানা বাস্তবতা থেকেই তার মধ্যে দুঃসাহস জন্ম নিয়েছে। আস্তে আস্তে তা পরিণত হয়ে ভয়ঙ্কর রুপে প্রকাশ ঘটেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতার প্রভাব, সামাজিক অপরাধ ও হানাহানি, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন দিন দিন বাড়ছে। পরিবার-গ্রামে বড়দের মান্য করার বিষয়টি কার্যত ওঠে গেছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ছাত্রদের শাসন করলে পরিদিন পরিবারের লোকজন দল বেঁধে শিক্ষকের বিচারের জন্য ছুটে যায়। সর্বোপরি অপরাধকে আশ্রয়, প্রশ্রয় দেয়ার নজির বেশি। যুবকদের হাতে অর্থেরও কোন অভাব নেই। তাই সে নিজের ইচ্ছেমত চলে। যা খুশি তাই করার সুযোগ পায়।

গ্রামের ভালো মানুষগুলো অপসংস্কৃতির কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তারা আর কোন কিছুতেই মাথা ঘামান না। সর্বোপরী অবাধ তথ্য প্রবাহ, মোবাইল ও ইন্টারনেট নতুন প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার সবশেষ পেরেক হিসেবে কাজ করেছে। জুয়া আর নেশা গ্রাস করছে উঠতি বয়সীদের। এসব কারণে পরিণত বয়েসের পর অনেক পরিবার চাইলেও ছেলে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। অর্থের অভাব থাকলেও নবম শ্রেনীতে পড়া ছেলেকে মোটরসাইকেল কিনে দিতে হয়। সন্তানের হিরো ইজমের কারণে একের পর এক অঘটন ঘটায়। এসব কারণে গ্রামের বিচার শালিসে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এমনকি ১৮ বছরের আগেই ছেলে মেয়ের বিয়ের আবদার পূরণ করতে হয়। এজন্য ছেলেবেলার প্রকৃত পারিবারিক শিক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া উচিত অভিভাবকদের। সর্বোপরী অভিভাবকরা যদি ভালো হন, তবেই সন্তানকে ভালো করা সম্ভব। অন্যথায় এরকম অঘটন একের পর ঘটতেই থাকবে। সমাজ আরো বেশি অন্ধকারের দিকে যাবে। তাই সবার উচিত ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা, এতে সহযোগিতা করা। বিচার নিশ্চিতে সামাজিক চাপ বাড়ানো। যা সমাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে।

নতুন প্রজন্মই একটি দেশের ভবিষ্যৎ চালিকাশক্তি। তারা সমাজে আলো ছড়াবে। উন্নয়ন, অগ্রগতি, অর্জন আর এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে ভালো কাজে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে। পরিবর্তন আনবে রাজনীতিতে। এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু দিন দিন সন্তানদের মানুষ হিসেবে বড় করে তোলা সকল অভিভাবকদের জন্য মহা-চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা বিপজ্জনক বাস্তবতা হলেও হতাশার কিছু নেই। সাহসের সঙ্গে সন্তানকে সুনাগরিক করে তোলার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে। কারণ আপনি, আমি কিংবা আমরা প্রত্যেকেই যদি হেরে যাই তাহলে দেশ হারতে হারতে পিছিয়ে যাবে। আমাদের সামনের সব আলোগুলো একে একে নিভে গিয়ে মহা অন্ধকার নিমজ্জিত হতে হবে। যা থেকে বেরিয়ে আসার আর কোন পথ থাকবে না।

বড় হয়ে মুক্তি কি না হতে পারত? অনেক কিছুই হতে পারত সে। কারণ এই বয়সে বাল্য বিবাহ, ইভটিজিং প্রতিরোধসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিল এএসএসসির এই পরিক্ষার্থী। তার মধ্যে ভালো কিছু কাজ করত। সুন্দর সমাজ ও আগামীর জন্য যে জীবনের শুরু থেকেই কাজ করে, সে কোনদিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। সচেতন মানুষের সফলতা অনিবার্য। তা আর হলো না। সবার চোখের সামনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো তাকে। আকাশের তারা হয়ে নদীর জলে মিশে গেছে মুক্তির স্বপ্ন। এরচেয়ে হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা হতে পারে?

বাবা-মা সহ পরিবারের লোকজন এই শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন? এক্ষেত্রে প্রশাসন সহ সমাজের সবাইকে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো জরুরী। অপরাধীর কঠোর বিচারের প্রতিশ্রুতি পেলে নিখিল বর্মণের অন্য সন্তানগুলো স্বাভাবিকভাবে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। মুক্তির অভাব কিছুটা হলেও গুছিয়ে দিবে সবাই মিলে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ দেশ ও সমাজ সহ বেড়ে ওঠার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে সবার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

মুক্তি রাজন ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর