উগ্রবাদের আস্ফালনের এক বীভৎস রাত
৫ মে ২০২৩ ১৮:৩০
দশ বছর আগের বৈশাখের এক মেঘলা বিকেল। ঢাকার শাপলা চত্বরে কওমি মাদ্রাসার কিছু ছাত্রদের নিয়ে বিশাল এক সমাবেশের মাধ্যমে চট্টগ্রামের হাটহাজারিভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ হেফাজতে ইসলাম সাম্প্রদায়িক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। উগ্রবাদের আস্ফালন কাকে বলে সে বিকেলে তা চাক্ষুষ করেছিলেন রাজধানীবাসী।
শুধু বিকেল নয়, ২০১৩ সালের ৫ মে রাতভর উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠী ঢাকার একাংশকে নরকে পরিণত করেছিল। বোমা ছুঁড়ে, আগুন জ্বালিয়ে, রাস্তার ছায়াদায়ী গাছ উপড়ে নগরীকে যেন পরিণত করেছিল সাক্ষাৎ নরকে। যদিও তাদের সেই আস্ফালন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাত না পেরুতেই লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল সেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। উগ্রবাদের পরিণতি সে-রাতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সরকার ও আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী।
তবুও থামেনি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন। ৫ই মে সমাবেশকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের গুজব এবং আলোচনার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ঘৃণ্য ওই ঘটনার দীর্ঘদিন পরও শাপলা চত্বরের সেই রাতের ঘটনা নিয়ে কল্পকাহিনী বানিয়ে গুজব রটনা করে গেছে একটি গোষ্ঠী। যথেষ্ট ধৈর্যধারণ করে ঘটনাটি মোকাবিলা করার পর আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর নামে গুজব রটনা শুরু হয়, লাশের রাজনীতির নামে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় জনগণকে।
পরবর্তীতে ক্রমেই সরকারের সঙ্গে দৃশ্যত একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলে হেফাজত। বিশ্লেষকদের মতে, হেফাজত ও সরকারের সুসম্পর্কের পেছনের কারণটি রাজনৈতিক। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজত যখন রাজধানীর রাস্তায় পেশীশক্তি প্রদর্শন করেছে ঠিক সেসময়ে সরকার ব্যস্ত যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন মোকাবিলায়। সে সময়ে সরকার নতুন করে উগ্রবাদী কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চায়নি। সেজন্য সুযোগসন্ধানী হেফাজতের আস্ফালনের পরেও সরকার তাদের মোকাবিলা করেছে নরম হাতে। এই সুসম্পর্ক পরবর্তীতেও বহাল রাখে সরকার। সময়ে সময়ে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা যেমন- রেলের জমি, মামলা থেকে নিষ্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে আঞ্চলিক এই গোষ্ঠীকে খুশি রাখার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে।
তবুও থেমে থাকেনি হেফাজতের উগ্রবাদী আস্ফালন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন করেছে সংগঠনটি। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আসা ঠেকাতে বিক্ষোভ করে সহিংসতা চালায় হেফাজতে ইসলাম। স্বাধীনতা দিবসের আগে এ ঘটনায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় হেফাজতের নেতাকর্মীদের। যার রেশ ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ ঘটনার পর হেফাজতের বিরুদ্ধে অনেকটা হার্ডলাইনে চলে যায় সরকার। দেশব্যাপী মামলা ও ধরপাকড় শুরু হয়।
সেদিনের সেই শাপলা চত্বরের ঘটনার দশ বছর পরে কেমন আছে হেফাজত? কীভাবেই বা পালন করছে ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ হয়েও রাজনীতিতে ভয়ংকর উত্থানের খায়েশে কোমলমতি শিশুদের ভয়ংকর পথে ঠেলে রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সেই বীভৎস ষড়যন্ত্রের দিনটিকে?
২০১৩ সালের পর প্রথম কয়েক বছর প্রবল বিক্রমে ঘৃণ্য এই দিবসটি পালন করলেও গত কয়েক বছর ধরেই যেন দিনটিকে ভুলে যেতে চায় হেফাজত। পরবর্তী সময়ে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি, সাধারণ পাঠ্যসূচি, সুপ্রিমকোর্টের সামনের ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে সরব হয় হেফাজত। এখন তারা নেতাদের বিভিন্ন মামলা সামলাতেই ব্যস্ত। গণমাধ্যমের বিভিন্ন সংবাদে জানা যায়, হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নামে দুই শতাধিক মামলা রয়েছে আর সেই মামলাগুলো নিয়ে দেনদরবারেই সময় কাটে ‘অরাজনৈতিক সংগঠনটির’ নেতাদের। মামলাগুলো থেকে মুক্তি পেতে প্রায়শই মন্ত্রীপর্যায়ে বৈঠকের ধর্না দিতে দেখা যায় সংগঠনটির নেতাদের। বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে হেফাজতের। নেতাদের মামলা থেকে মুক্তি পেতে হেফাজতের এসব দেনদরবারের ফলও মিলেছে অনেকখানি। হেফাজতের নেতাদের অনেকেই এখন জামিনে মুক্ত।
গণমাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, নির্বাচনের আগের এই সময়ে সরকার ধর্মভিত্তিক এ রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে আর বৈরিতা চায় না। চায় হেফাজতের নেতাদের আগামী নির্বাচনে কাজে লাগাতে। তাই অধিকাংশ মামলা নিষ্পত্তি করে কিছু মামলা ঝুলিয়ে রাখার কৌশলে এগুচ্ছে সরকার। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়, কিন্তু মেরি শেলীর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পে বর্ণিত দানবকে পেলে পুষে নধর করে তুললে সেই দানবীয় শক্তি একসময় বের হয়ে আসবেই। ২০১৩ এর ৫ মে-তে হেফাজতের দুরভিসন্ধি সফল হয়নি বটে। কিন্তু ধর্মের নামে- ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ জনগণকে উসকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে একটি মহল সদা সক্রিয়। এদের বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হবে শান্তিকামী সাধারণ মানুষকেই।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই