স্বপ্ন সারথির হাত ধরে অস্তিত্বে ফেরা বাংলাদেশের
১৭ মে ২০২৩ ১৬:২৬
তিনি ইতিহাসের রাজকন্যা। এক অন্ধকার রাতে হারিয়েছেন পরিবারের সবাইকে। বিবর্ণ এক চেহারায় তখন বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ। সামরিক জান্তার কবলে নির্বাসিত গণতন্ত্র। কিন্তু দেশের কল্যাণ ও মুক্তির চিন্তায় ব্যাকুল বাঙালি জাতির ঐক্য আর আদর্শের আলোকবর্তিকা বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর ব্রত নিয়েই জোরপূর্বক নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে প্রায় ৬ বছর পর দেশে ফিরেন গণতন্ত্রের অগ্নিবীণা। সময়টি ১৯৮১ সালের ১৭ মে। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে সামরিক স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বাংলাদেশকে নিজের স্বকীয় অস্তিত্বে ফিরিয়ে আনতে পা রাখলেন দেশের মাটিতে। মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তেভেজা মাটিতে তাকে বহনকারী বিমান স্পর্শ করার খানিক সময় বাদেই যেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে।
সেদিন প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে চারবারের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক পলক দেখতে, তাকে স্বাগত জানাতে গোটা বিমানবন্দর এলাকা হয়ে ওঠে লোকে লোকারণ্য। এ যেন এক জনসমুদ্র। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলানগর পর্যন্ত এলাকায় লাখো জনতার ঢল। বাংলার আকাশও সেদিন কেঁদেছিল অঝোরে, বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দে। দেশের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-ভালোবাসার মায়াবি মোহনায় তিনি নিজেও রুদ্ধ করতে পারেননি আবেগের অশ্রুকে; ভেঙে পড়েন কান্নায়। ঝড়-বৃষ্টির আকাশ কাঁপিয়ে জননেত্রীকে বহনকারী ট্রাকের চারপাশে সামরিক তন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মুক্তি পাগল লাখো কন্ঠের সমস্বরে স্লোগান- ‘পিতৃ হত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই/রাজপথ ছাড়ি নাই।’ সামরিক শাসক তো বটেই প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির বৈরি আবহাওয়াও ঠেকাতে পারেনি গণসমুদ্রের প্রবল জোয়ার।
ওইদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণসংবর্ধনায় শোকে পাথর বাঙালির আশার বাতিঘর, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ হুবুহু নিজের কথা রেখেছেন দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশের মানুষকে দেওয়া নিজের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রায় ৪২ বছর মৃত্যুভয়কে পায়ে পায়ে জয় করে পাহাড় কেটে পথ চলেছেন নিরন্তর। দেশের আপামর জনসাধারণের ভাগ্যবদলে চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলস প্রয়াস। দেশপ্রেমই তার রাজনীতির মূল শক্তি। জনগণই তার সকল ক্ষমতার উৎস।
বাঙালি জাতির আলোর দিশারী শেখ হাসিনার জীবন বৈচিত্র্যময়। লড়াই-সংগ্রাম-অর্জনের একখণ্ড মহাকাব্য! মানবিক কোমল হৃদয়ে, মমতাময়ী মায়ের আদরে দেশের মানুষকে আগলে রেখেছেন বুকের উত্তাপে। বাতিঘর হিসেবে আলোকিত করেছেন দেশবাসীর অন্তরাত্মাকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- ‘শেখ হাসিনা হচ্ছেন সেই নেত্রী যিনি সঙ্কটকে সম্ভাবনায় রূপ দেন। ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে ওড়ান সৃষ্টির পতাকা। তিনি মৃত্যুর মিছিলে দাঁড়িয়ে গেয়ে যান জীবনের জয়গান। স্বজন হারানোর কষ্ট ভুলে থাকেন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্য দিয়ে। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নকে তিনি করেছেন জীবনের ব্রত।’
ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেওয়া শেখ হাসিনা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বিপদসঙ্কুল, জেল-জুলুমের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। অবিকল পিতা মুজিবের মতোই গভীর দেশপ্রেম, দুর্জয় সাহস, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা আর কর্মকুশলতায় দেশকে বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। সংগ্রাম আর জনগণের আস্থায় বারবার ক্ষমতায় এনেছেন আওয়ামী লীগকে। ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চিত করেছেন মানবাধিকার ও সুশাসন। জাতির পিতার খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করেছেন। এর মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত করেছেন জাতিকে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের আশা ও আলোর উৎসবিন্দু হয়ে আমাদের পথ দেখাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ৭৫ বছর বয়সী মমতাময়ী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৪২ বছর যাবত হাল ধরে রেখেছেন আওয়ামী লীগের, নৌকার। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। নিন্দুকদের চেহারায় ধুলোর ঝাপ্টা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ করেছেন। এই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দিয়েছেন শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান। নিজেদের টাকায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে গোটা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন বীরের জাতি বাঙালি পারে।উত্তাল পদ্মার বুকে জাতির গৌরবের প্রতীক হয়ে এখন দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু।
বিশ্ব দরবারে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাংলাদেশকে পথচলার মন্ত্র শিখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ উন্মুক্ত হয়েছে। চলতি বছরেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে চালু হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। পদ্মার বুকে পরীক্ষামূলকভাবে চলেছে ট্রেন। সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) ১০ প্রকল্পের অন্যান্য প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। গ্রামে শহুরে জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে গ্রাম হবে শহর কনসেপ্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে পুরোদমে। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে দেশের শতভাগ মানুষ। এতে করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চার হয়েছে নতুন গতির।
করোনার পর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশের অর্থনীতি হিমশিম খেলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টায় সচল রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।
‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক মণ্ডলেও বিভিন্ন খেতাব, পুরস্কারসহ মানবিক উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন । বিশ্বের তাবৎ পরাক্রমশালী নেতারাও আজ তার নেতৃত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বঙ্গবন্ধুকন্যার ম্যাজিক্যাল নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে অনুকরণীয় সুদৃঢ় অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে, সে কথা এখন বিশ্বনেতারাও উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই স্বীকার করছেন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘আপনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘আমি আপনাকে অনেক বছর ধরে অনুসরণ করছি। আপনি একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটাও বলেছেন, তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী তার (শেখ হাসিনা) বড় ভক্ত।
প্রকৃত অর্থেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ইচ্ছায় অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করেছেন। সঙ্কট উত্তরণে দক্ষ ক্রাইসিস ম্যানেজার বলেই কীনা তিনি আজ বিশ্বনেতা এবং শান্তির অগ্রদূত। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। ১৯৮১ সালের আজকের এই দিনে তিনি ফিরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। কবিগুরুকে উদ্ধৃত করে আমি আমার দীর্ঘ লেখাটির দাঁড়ি টানতে চাই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘নীহারিকার মহাক্ষেত্রে যেখানে জ্যোতিষ্ক সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে মাঝে মাঝে এক-একটি তারা দেখা যায়; তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সমস্ত নীহারিকার বিরাট অন্তরে সৃষ্টি-হোমহুতাশনের উদ্দীপনা।’ বাঙালির সুদিনের নির্মাতা শেখ হাসিনা ‘নীহারিকার মহাক্ষেত্রে’ সেই জ্যোতিষ্ক। তিনি বাঙালির অন্তরে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। আসুন, কবিগুরুর কন্ঠে উচ্চারণ করি–‘তোমারে করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা/ এ সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথহারা।’ জয়তু শেখ হাসিনা। তিনি যেন এক হীরকখণ্ড যার দ্যুতিতে প্রোজ্জ্বল স্বদেশের আঙিনা, বিশ্ব পরিমণ্ডলে উজ্জ্বল আলোকিত আমাদের বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার ৪৩ তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বিনম্র অভিবাদন আপনাকে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু; বাংলাদেশ চিরজীবী হউক।
লেখক: সংসদ সদস্য ও সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)
সারাবাংলা/এসবিডিই
আব্দুস সালাম মূর্শেদী মত-দ্বিমত স্বপ্ন সারথির হাত ধরে অস্তিত্বে ফেরা বাংলাদেশের