বাংলা পত্রিকার ২০৫ বছর
২৩ মে ২০২৩ ১৪:২৫
ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলে প্রথম কবে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে এ অঞ্চলে সাংবাদিকতা কর্মের অস্তিত্ব খুবই প্রাচীন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সেই মৌর্য যুগে রাজদরবারে এক ধরনের রাজকর্মচারী ছিল, যারা রাজ্যের নানা জায়গা থেকে খবরাদি সংগ্রহ করত। এদের বলা হতো প্রতিবেদক। তাদের কাজটি ছিল আজকের যুগের রিপোর্টারদের মতো। সেটি ছিল আসলে সাংবাদিকতা। এক কথায় আমরা বলতে পারি, খ্রিষ্টের জন্মের আগেও এ অঞ্চলে সাংবাদিকতা কাজের প্রচলন ছিল। তবে বাংলা অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা তথা সংবাদপত্রের প্রচলন ঘটেছে ব্রিটিশ আমলে।
প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশের পর এবার ২০৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। যদিও এই প্রশ্ন তর্কাতীত নয়, তবু সমাচার দর্পণকে প্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়। অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে সংবাদপত্র এখন শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে।
২০৫ বছর আগে ১৮১৮ সালের ২৩ মে এটি বের হয় শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে। জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড ছিলেন সাপ্তাহিকটির উদ্যোক্তা; আর জন ক্লার্ক মার্শম্যান ছিলেন সম্পাদক। এর দাম ছিল চার আনা। ১৮৩৬ সালে পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল ৪০০, যা ওই সময়ে সর্বোচ্চ। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
সমাচার দর্পণ প্রকাশের চার দশক আগেই ভারতবর্ষে আধুনিক সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে। ১৭৮০ সালে বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার নামে দুই পাতার ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। তিনি এ জন্য দুই বছর আগেই কলকাতায় ছাপাখানা বসান। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকা ছিল ইংরেজি এবং ইউরোপীয়দের দ্বারা সম্পাদিত বা পরিচালিত।
১৮১৮ সালের এপ্রিলে দিগদর্শন নামে বাংলা মাসিকপত্র বের করে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন। এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িকী। সম্পাদক জন ক্লার্ক মার্শম্যান। পত্রিকার ২৬টি বাংলা সংস্করণ এবং ১৬টি ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি সংস্করণের নামপত্রে লেখা হতো ‘ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ’। সাময়িকীতে নিবন্ধের পাশাপাশি কিছু গল্পও ছাপা হতে থাকে। ১৮২১ সালের পরে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
বাঙালি নিয়ন্ত্রিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র বাঙ্গাল গেজেট (১৮১৮)। এর কোনো কপি পাওয়া যায়নি। ফলে এর সঠিক প্রকাশ-তারিখ জানা যায় না। বাঙ্গাল গেজেট–এর প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, আর সম্পাদক ছিলেন হরচন্দ্র রায়। পত্রিকাটি চলেছিল বছরখানেক।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) প্রথম সাহিত্যপত্রিকা। তিনি সংবাদ রত্নাবলী (১৮৩২), পাষণ্ড পীড়ন (১৮৪৬) ও সংবাদ সাধুরঞ্জন (১৮৪৭) নামে আরও তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৩১ সালে মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা সমাচার সভারাজেন্দ্র বের হয়। সাপ্তাহিকটির সম্পাদক ছিলেন শেখ আলিমুল্লাহ।
অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পদনায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৯০ বছর ধরে এটি প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৪৬ সালে মৌলভী ফরিদুদ্দীন খাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত জগদুদ্দীপক ভাস্কর নামের সাপ্তাহিকটি ছিল পঞ্চভাষিক। প্রথম সচিত্র পত্রিকা বিবিধার্থ সংগ্রহ (মাসিক) প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায়। নারীদের জন্য প্রথম সাময়িকী মাসিক পত্রিকা (১৮৫৪) বের করেন প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাধ শিকদার।
পূর্ববাংলার প্রথম পত্রিকা রংপুর বার্তাবহ (১৮৪৭)। সাপ্তাহিকটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুন্ডির জমিদার কালীচরণ রায়চৌধুরী আর সম্পাদক গুরুচরণ রায়। পত্রিকা প্রকাশের জন্য রংপুরে স্থাপিত মুদ্রণযন্ত্রটিই এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন। ঢাকার প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা নিউজ আলেকজান্ডার ফর্বেসের সম্পাদনায় বের হয় ১৮৫৬ সালে। ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত সোমপ্রকাশ থেকে সমাজ-রাজনীতি ছাপা হতে থাকে।
ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ঢাকা প্রকাশ (১৮৬১) বের হয় বাবুবাজারের ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ থেকে, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায়। এটি চলে ১০০ বছর। আগের বছর কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পাদনায় বের হয় কাব্যবিষয়ক সাময়িকী কবিতাকুসুমাবলী। এটি পূর্ববাংলার প্রথম সাময়িকপত্র। কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে মাসিক গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বের করেন। এ ছাড়া পূর্ববাংলায় নিয়মিত প্রকাশিত সংবাদপত্রের মধ্যে ছিল ই. সি. কেম্পের বেঙ্গল টাইমস (১৮৭১) ও কালীপ্রসন্ন ঘোষের বান্ধব (১৮৭৪)।
উমেশচন্দ্র দত্তের নারী-সাময়িকী বামাবোধিনী (১৮৬৩) একটানা ছয় দশক প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গদর্শন (১৮৭২) এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। ১৮৭৭ সালে ঠাকুর-পরিবারের উদ্যোগে বের হয় মাসিক ভারতী। অর্ধশতাব্দী ধরে চলা এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখ। এই পরিবারের সম্পাদনায় প্রকাশিত আরও দুটি পত্রিকা বালক (১৮৮৫) ও সাধনা (১৮৯১)। বিহারীলাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় পূর্ণিমা (১৮৮৭), অবোধবন্ধু (১৮৬৮) সহ তিনটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সালে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় বের হয় সাপ্তাহিক হিতবাদী।
১৮৯৪ থেকে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে’র মুখপত্র হিসেবে প্রতিমাসে প্রকাশিত হতে থাকে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা। এই গবেষণা-পত্রিকাতেই চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ছাপা হয়। মীর মশাররফ হোসেনের মাসিকপত্র আজীজন নেহার (১৮৭৪) ও পাক্ষিকপত্র হিতকরী (১৮৯০), শেখ আবদুর রহিমের সুধাকরসহ উনিশ শতকের শেষভাগে ছিল আরও কিছু পত্রিকা।
১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় সৈয়দ এমদাদ আলীর সম্পাদনায় মাসিক সাহিত্যপত্র নবনূর। একই বছর কলকাতা থেকে বের হয় মোহাম্মদ আকরম খাঁর মাসিক মোহাম্মদী। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় ছোটদের মাসিক পত্রিকা সন্দেশ বের হয় ১৯১৩ সালে। পরের বছর প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরীর মাসিক সবুজপত্রকে বলা হয় চলিতরীতির প্রথম পত্রিকা। ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বের করেন মাসিক সওগাত। একই সালে বের হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আবদুর রশীদ সিদ্দিকীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক সাধনা। মোজাম্মেল হক ১৯২০ সালে প্রকাশ করেন মোসলেম ভারত।
কাজী নজরুল ইসলামের পত্রিকার মধ্যে রয়েছে নবযুগ, লাঙল ও ধূমকেতু। কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে সম্পাদনা করেন নবযুগ (১৯২০)। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট প্রকাশ করেন অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু। সাপ্তাহিক লাঙল (১৯২৫) প্রকাশিত হয় ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায়ের মুখপত্র’ হিসেবে। এর প্রধান পরিচালক ছিলেন নজরুল নিজে; সম্পাদক মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। লাঙল পরে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের গণবাণী (১৯২৬)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলা সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কল্লোল (১৯২৩)। সম্পাদক ছিলেন দীনেশচন্দ্র দাস। এর পরের বছর প্রকাশিত সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন যোগানন্দ দাস। ১৯২৮ থেকে দায়িত্বে আসেন সজনীকান্ত দাস। সমকালীন আরেকটি পত্রিকা মাসিক কালিকলম (১৯২৬)। সম্পাদনা করেছেন মুরলীধর বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্তের প্রগতি (১৯২৬), সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূর্বাশা (১৯৩২) এবং বুদ্ধদেব বসুর কবিতা (১৯৩৫) কলকাতাকেন্দ্রিক এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা।
১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শিখা (১৯২৭) ছিল এই সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র।
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক পয়গাম। সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী। একই সময়ে প্রকাশনা শুরু হয় জিন্দেগী নামের অর্ধসাপ্তাহিকের। মওলানা আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ তখন কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসে।
ইত্তেফাক ১৯৪৯ থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে ও ১৯৫৩ সাল থেকে দৈনিক হিসেবে এবং দৈনিক সংবাদ ১৯৫১ থেকে ছাপা হতে থাকে। এই দুটি পত্রিকা দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে ছিল।
সংবাদপত্রের ইতিহাস
১৫৬৬ সালে ভেনিসে হাতে লেখা সংবাদ প্রচার করা হতো। চারটি কাগজ একসঙ্গে গোল করে পেঁচিয়ে পাঠকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো সপ্তায় সপ্তায়। ইতালি ও ইউরোপের যুদ্ধ ও রাজনীতির খবর থাকত এসব কাগজে।
১৬০৯ সালে প্রথম ছাপা সংবাদপত্র বের হয় জার্মানি থেকে, জোহান ক্যারোলুসের উদ্যোগে। জার্মান ভাষায় প্রকাশিত রিলেশন নামের এই পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক।
ইংরেজি ভাষার প্রথম সংবাদপত্র বের হয় আমস্টার্ডাম থেকে, ১৬২০ সালে। ফ্রান্সের প্রথম পত্রিকা বের হয় ১৬৩১ সালে এবং আমেরিকার প্রথম সংবাদপত্র বের হয় ১৬৯০ সালে।
ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট। ১৭৮০ সালের জানুয়ারিতে জেমস অগাস্টাস হিকির সম্পাদনায় বের হয়। চার পাতার এই পত্রিকার আকার ছিল ১২ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চি।
পতুর্গিজরাই প্রথম ভারতে মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে আসে। ১৫৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কাঠের তৈরি ছাপার যন্ত্র জাহাজ থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলের গোয়ায় নামানো হয়েছিল। ওই বছরেই নাকি সেখান থেকে বই ছাপা হয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু সে বই কেউ চোখে দেখেনি। হুগলিতে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৭৮ সালে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই