হ্যাঁ/না ভোট: জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের ভোটচুরির প্রবর্তক
২৯ মে ২০২৩ ১৬:১৭
৩০ মে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিন। ১৯৭৭ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ভোটাধিকার চুরি করেন জিয়াউর রহমান। ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা ‘হ্যাঁ’ ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছিল। ভোটারবিহীন নির্বাচনে সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারা তাদের চাকরি বাঁচাতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই জিয়ার পক্ষে নগ্নভাবে ব্যালোটে সিল মারতে হয়েছিল। জিয়ার সেই প্রহসনের নির্বাচনে তিনি একাই প্রার্থী ছিলেন। গনতন্ত্রের ইতিহাসে এমন নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান, এটা আজ ইতিহাসে স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট করা হলেও নেপথ্যের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করেন জিয়া। হয়ে যান সেনাপ্রধান। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান ও উপ-সামরিক প্রশাসক থেকে প্রধান সামরিক পদ দখল করেন এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সায়েমকে অস্ত্রের মূখে ভীতি প্রদর্শন করে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতি হন। এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম ‘বঙ্গভবনে:শেষ অধ্যায়’ নামক তার বইতে লিখেছেন, ‘জিয়া বঙ্গভবনে আসতেন মধ্য রাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, তার সাঙ্গোপাঙ্গরা অস্ত্র উঁচুয়ে রাখত। আমি প্রায়ই মনে করতাম এটাই বোধ হয় আমার শেষ রাত। সংবিধানের ৪টি মূল স্তম্ভ বাতিল সংক্রান্ত একটি সামরিক ফরমান আমার কাছে স্বাক্ষরের জন্য আসে। আমি ওই ফরমানে স্বাক্ষর না করে তা রেখে দেই। পরদিন রাত ১১টায় বুটের শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গে। সেনাপ্রধান জিয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ বঙ্গভবনে আমার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেন। জিয়াউর রহমান আমার বিছানায় তার বুটসহ পা তুলে দিয়ে বলেন, সাইন ইট। তার এক হাতে ছিল স্টিক, অন্য হাতে রিভালভার। আমি কাগজটা পড়লাম। আমার পদত্যাগপত্র। যাতে লেখা:অসুস্থতার কারণে আমি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আমি জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আট-দশজন অস্ত্রধারী আমার বিছানার চারপাশে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিয়া আবার আমার বিছানায় পা তুলে আমার বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে বললেন, সাইন ইট। আমি কোনোমতে সই করে বাঁচলাম।’ বইটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হলেও ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে বইটি বাজেয়াপ্ত করে। এমন হিংস্রতা প্রমান করে জিয়া কতটা ক্ষমতালোভী ছিলেন। ক্ষমতার জন্য একজন রাষ্ট্রপতির সাথে এত নোংরা ব্যবহার করতে পারেন, তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন, মানুষরুপী দানব।
জিয়া নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে একের পর এক সামরিক ফরমান জারি করতেন। প্রথমে একটি সামরিক ফরমান জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক ঘোষণা, পরবর্তীতে আরেকটি সামরিক ফরমান জারি করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। নিজেই নিজের প্রস্তাবক ও সমর্থক। এমন একনায়কতন্ত্র স্বৈরশাসক ইতিহাসে কি দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে?
বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট ২৯২ ও ২৯৩ বিধিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য তার চাকুরির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীতে সেনাপ্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেজন্য হ্যাঁ/না ভোটে প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনগতভাবেই তিনি অবৈধ রাষ্ট্রপতি। তার কুকর্ম এখানেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি, একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি পদে থাকার জন্য ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল একটি সামরিক ফরমান জারি করেন। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে দেশের সংবিধান, আইন-কানুন, সামরিক বাহিনীবিধি অবৈধভাবে বারংবার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো বিরোধী দলের প্রচার ছিল না। তারপরও জনগণের আস্থা অর্জন করতে গণভোটের তিন মাস আগে থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রচারণা চালানো হয়। জনগণের সামনে ১৯ দফা কর্মসূচীর একটি মুলা ঝুলানো হয়। শুধু বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ওপর আপনার আস্থা আছে কি না (হ্যাঁ / না)। জিয়াউর রহমানের পক্ষে বিপুল সংখ্যক হ্যাঁ ভোট নিশ্চিত করতে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা জেলায় জেলায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে নির্দেশনা দেন। এতোকিছু করার পরও জনরায়ের পক্ষে তারা নিশ্চিত ছিলেন না। এজন্যই গণভোটের নামে ভোট চুরির মহোৎসব হয়। হ্যাঁ পক্ষে গণজোয়ার দেখানো হয়। ভোট কেন্দ্র কোনো ভোটার উপস্থিত না হলেও ভোটের বাক্স সরকারি কর্মকর্তারা ভরে দিয়েছিল। দুই শতাংশ ভোটার উপস্থিত না হলেও উপস্থিতির হার দেখানো হয় ৮৮.১ শতাংশ। আর প্রদত্ত ভোটের ‘হ্যাঁ’ অর্থাৎ জিয়ার পক্ষে দেখানো হয় ৯৮.৯ শতাংশ। গনতন্ত্রের ইতিহাসে এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কি হতে পারে?সেদিন সামরিক উর্দি পরে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও, বিদেশি গণমাধ্যমগুলো ভোট চুরির ঘটনা ফলাও করে প্রচার করেছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে কোথাও কোথাও ১১০-১২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
জিয়া ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করেন। প্রথমে জাগদল, পরবর্তীতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। সেটা ছিলো ভোট চুরির আরেকটি মহোৎসব। সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি ও নেজামে ইসলামের মতো দলগুলোকে নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংসদে আসার সুযোগ করে দেন। ভোট চুরির মাধ্যমে জিয়া নিজের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে ২০৭টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করে। বিএনপির টিকিটে বিরাট সংখ্যক যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংসদে নিয়ে আসা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে দালান আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তি, সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার কারণে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি ও নেজামে ইসলামকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়।
পরবর্তীতে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন আরেক সেনাশাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ও জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদও একই কায়দায় ক্ষমতা দখল করে ’৮২ সালে গণভোট, ’৮৬ ও ’৮৮ সালে দুইটি বিতর্কিত নির্বাচন করেন। আর খালেদা জিয়া স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটার বিহীন প্রহসনের একটি নির্বাচন করেন। কিন্তু প্রবল জনবিদ্রোহের কারণে মাত্র তিনমাসের মধ্যে পদত্যাগে বাধ্য হন। আবার ২০০৬-০৭ সালেও একই পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমান। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের পাঁয়তারা শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আপামর জনগণের দুর্বার আন্দোলনে কারণে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা দখল করে।
জিয়ার ক্ষমতা দখল ও তার নির্বাচন প্রক্রিয়া যে সম্পূর্ণরূপে অবৈধ ছিলো তা আইনগত ভাবেও স্বীকৃত। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক, আবু সায়েম ও জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। আইনগতভাবে জিয়ার শাসনামল অবৈধ হলে জিয়াও বাংলাদেশের অবৈধ রাষ্ট্রপতি। এটা কারোরই অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশে জিয়াই প্রথম ভোট চুরি-জালিয়াতির প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে এরশাদ ও খালেদা জিয়া ভোট চুরির ধারাবাহিকতা চালিয়ে যান। আর এই তিনটি সরকারের সময়েই দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই বিগত চৌদ্দ বছর ধরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার মত-দ্বিমত হ্যা/ না ভোট: জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের ভোট চুরির প্রবর্তক