Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চীনে বাংলা শিক্ষা ও গবেষণার চাহিদা পূরণ প্রসঙ্গে

ড. এ বি এম রেজাউল করিম
৫ জুন ২০২৩ ১৬:০৪

বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিদ্যায়তনিক (একাডেমিক) চর্চা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যকার পারস্পরিক সংজ্ঞাপন ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারণে বিশ্বের নানা দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম প্রসারিত হচ্ছে। অনেক দেশে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা শুরু হয়েছে ও তার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্বের ৪ মহাদেশের ৩০টি দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এ ছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্ররচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ থেকে শুরু করে লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষাতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে। গবেষকেরা মনে করছেন, ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পরপর বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

যে সব দেশে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা বৃদ্ধি পাচ্ছে, চীন তার মধ্যে অন্যতম। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে গত এক দশকে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো-
১) চীন সাংজ্ঞাপনিক বিশ্ববিদ্যালয়; ২) বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩) গুয়াংজু বিদেশ বিদ্যা ও বৈদশিক বাণিজ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৪) ইউনান জাতিসত্ত্বা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় নন-ডিগ্রী শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাথে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের একাডেমিক যোগযোগ চলছে এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রথম ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষা ও গবেষণা সহযোগিতা সহায়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইউনান জাতিসত্ত্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে।

বিজ্ঞাপন

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ও গবেষণায় সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে যোগাযোগ করে চলেছে। যে সব বিষয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লিখেছে তা হলো-
১) ৪ বছর মেয়াদী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শিক্ষাকার্যক্রমের ৩য় বর্ষ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে সম্পাদনের সুযোগ রেখে যৌথ স্নাতক ডিগ্রী শিক্ষাকার্যক্রম চালু করা।
২) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।
৩) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্বল্পমেয়াদী গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।
৪) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত চীনা শিক্ষকদের জন্য বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা।
৫) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত চীনা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে সেমিনার ও সম্মেলন আয়োজন।
৬) চীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি।
৭) চীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে যৌথ গবেষণা পরিচালনা।
৮) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠনুশীলন অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি।
৯) চীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা করা।
১০) আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শ্রেণিকক্ষে বিদেশিদের বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা পাঠদানের ভিডিও ধারণ এবং তা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো।
১১) বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তকের তালিকা সরবরাহ।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়ে উক্ত চাহিদাগুলো জানিয়ে যোগাযোগ করছে বলে আমরা বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী সে সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় কী কী প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে তা আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট সঠিকভাবে জানে না।

এখানে উল্লেখ্য, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনায় চাহিদা মোতাবেক সহযোগিতা প্রদানের মতো প্রস্তুতি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট নেই। কারণ এসব চাহিদা পরিপূরণে প্রয়োজনীয় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সংগতি ও অবকাঠামো নেই। কারণ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এর সৃষ্টিলগ্নে যেসব সক্ষমতা নিয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা করছে, সেই সক্ষমতাই এখনও বজায় রয়েছে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় সারাবিশ্বে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলেও, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিটের যুগোপযোগী উন্নয়ন গ্রহণ করা হয়নি। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটকে বিশ্বায়নের সাথে খাপ খাওয়ানো মতো অবস্থায় বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমকে উন্নীত করার দায়িত্ব মূলত আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু যুগোপযোগী সক্ষমতা অর্জনে যে মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন তা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের নেই।

কারণ এই মহাপরিকল্পনা হবে ব্যাপকভিত্তিক। এই মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সংগতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের রূপকল্প। কাজেই প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা ব্যাপ্তি চিন্তা করলে, তা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায় বর্তায় উর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর। সে হিসাবে এই মহাপরিকল্পনার দায় বর্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এর সার্বিক দায় ও দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর।

বস্তত বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা প্রবৃদ্ধ হচ্ছে। কাজেই বিদেশিদের উদ্যোগে বিদেশে গৃহীত বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের উন্নয়নে সহযোগিতা করা প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষীর নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয় বরং দায়িত্ব রয়েছে প্রতিটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের, প্রাতিষ্ঠানের ও সরকারের। এই দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে আমাদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষা বাংলা বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে না। নানান ভাষার সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বিশ্বায়নের ভাষা হিসাবে এর গুরুত্ব হারিয়ে যাবে।

লেখক: পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট

সারাবাংলা/এসবিডিই

চীনে বাংলা শিক্ষা ও গবেষণার চাহিদা পূরণ প্রসঙ্গে ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর