বিদ্যুতের মতো পানির মিটার বসানো হোক
৭ জুন ২০২৩ ১৭:৩৪
ঢাকা ওয়াসা বলছে, গরমের কারণে রাজধানীতে এখন দৈনিক পানির চাহিদা ৩০০ কোটি লিটার। ওয়াসা দৈনিক উৎপাদন করতে পারে ২৮০ কোটি লিটার। তার মানে ঘাটতি থাকছে। আর উৎপাদনের পুরাটার সঠিক ব্যবহারও করতে পারছে না সংস্থাটি। কেননা বাসা-বাড়িতে অপ্রয়োজনে কল ছেড়ে পানির অপচয়সহ নানা কারণে প্রায় ২০ শতাংশ পানি নষ্ট হয় প্রতিদিন। ফলে গরমের সময় পানির সংকট বেশি দেখা দেয় রাজধানীতে। সমস্যা কেটে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি। তাছাড়া ওয়াসার উৎপাদিত মোট পানির প্রায় ৬৭ শতাংশই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। কিন্তু এই উৎসই এখন ঝুঁকির মুখে। তাছাড়া ওয়াসার এমডি তাকসিম এইচ খানের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ডজনখানে আর্থিক অনিয়ম তো আছেই। আজকের আলোচনার বিষয় সেটি নয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ জায়গা মুক্ত থাকা জরুরি। যেখানে মাটি উন্মুক্ত থাকবে যাতে বৃষ্টির পানি ভুগর্ভস্থ ধরে রাখতে পারে। কিন্তু ঢাকার অধিকাংশ জায়গাতেই পাকা বা পিচঢালাই হওয়ায় মাটি পানি ধরে রাখার সুযোগ কম পায়। যতটুকু পায় চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। তাছাড়া ব্যাপক জলাশয় ভরাট এই শহরকে বড় বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচেছ। ফলে প্রতিবছর ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নামছে। যে কারণে গত কয়েকদিন ঢাকার ৩৫ টি এলাকায় তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যার পর পানি না থাকায় চরম সংকটে পড়েছেন নগরবাসী।
৭ জুন প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনের একটি বিশেষ প্রতিবেদন বলছে, গেল ৫ ও ৬ জুন ঢাকার ৩৫ টি জায়গায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ঐ রিপোর্ট আরও বলছে, ঢাকা ওয়াসার লাইনে পানি না থাকলে অথবা পানিসংক্রান্ত সমস্যা হলে সংস্থাটির হটলাইন নম্বর ওয়াসা লিংক-১৬১৬২-এ অভিযোগ করা যায়। ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার ওয়াসা লিংকে ফোন করে ৪৫৬ জন পানি নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তার একদিন আগে রোববারও পানি নিয়ে ওয়াসা লিংকে ৪১৮টি অভিযোগ আসে। তাদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ ছিল পানি পাচেছন না তারা।
যেহেতু ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের কোন উদ্যোগ এই সরকারও নেয়নি তারমানে নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই শহরের জন্য আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। তার মানে প্রতিদিন এই শহর নতুন নতুন মানুষের ভার বইছে। অন্য দিকে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নীচে নামছে। তাই পানির সংসট সমাধানে এই কার্যকরি কিছু করা দরকার।
এজন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রস্তাব করছি- বিদ্যুতের মিটারের মতো ঢাকায় বাসা-বাড়িতে পানির মিটার লাগানো হোক। এটি শুধু আমার দাবি নয়, এদেশের পরিবেশবাদী বড় বড় সংগঠনেরও দীর্ঘ দিনের দাবি। ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা এই দাবি জোরালোভাবে করে আসছে। ঐ বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সেমিনারে পানির অপচয় ঠেকাতে বিদ্যুতের মতো মিটার লাগানোর পরামর্শ দেন বাপা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
ঢাকা শহরের মানুষের মাঝে পরিবেশ নিয়ে বরাবরই উদাসীনতা দেখা যায়। যে কারণে দিনকে দিন এই শহর বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সবার উদাসীনতার এই সুযোগে ঢাকার ভূমিদস্যুরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারছে। এসব ভুমিদস্যু আবার কিছু গণমাধ্যমেরও মালিক। তাই তাদেরকে থামাতে হিমশিম খাচেছ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। রাজউকের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাও তাদেরকে সহায়তা চিচ্ছে পাত্তির বিনিময়ে। তাই এ শহরে পুকুর হারিয়ে যাচ্ছে। গেন্ডারিয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী পুকুরকে বাঁচাতে গেল ১ মাস আন্দোলন করে যাচ্ছে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন। এই শহরের মানুষ এখনো পুকুর বা জলাশয় ভরাটকে অপরাধ মনে করে না। অথচ গুলিস্তান মার্কেটে আগুন লাগার পর পুকুরের প্রয়োজনীয়তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচেছ সরকারের বড় বড় মন্ত্রীরাও পরিবেশের ব্যাপারে অজ্ঞ। সুউচ্চ ভবন নির্মাণকেই তারা উন্নত রাষ্ট্রের প্রতীক মনে করছেন। আমি মনে করি, অতীতের সব সরকার-ই ঢাকা শহরকে ধ্বংসের জন্য দায়ি। আর প্রশাসনে থাকা মাথা মোটা আমলাদের অধিকাংশও মনে করেন উন্নয়ণ আগে, পরিবেশ রক্ষা পরে। তারা শুধু মাথা মোটাই নন, বরং জ্ঞানপাপীও। বিশ্বের উন্নত দেশের সব খবরই তারা রাখেন। পরিবেশ সুরক্ষায় সেই সব দেশ কী কী করছে বিদেশ সফরে যেয়ে নিজ চোখে তা দেখেও এসেছেন অনেকে। তারপরও দেশে এসে সরকারকে তেল মারতে উল্টা-পাল্টা জ্ঞান দেন। সহমত পোষণই যেন এদের ধর্ম। কারণ তেলবাজিতেই মেলে তাদের পদোন্নতি। দেশের বারোটা বাজলেও নিজের আখের গোছানোটাই ব্যস্ত তারা।
ফলে সবুজ–শ্যামল ও ছায়া সুবিড় ঢাকা নিয়ে কেউ থাবছেন না। চিন্তা করে দেখুন তো কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকার প্রাণ ও প্রকৃতি। এই শহরে এখন পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গে না কারোরই।
ঢাকার কোন এলাকায় গ্যাস নেই, বিদ্যুত নেই আবার কোন এলাকায় পানি নেই- বছরজুড়েই ভোগান্তির এমন চিত্র পাওয়া যাবে এখানে। তারপরও এই শহরকে বাঁচাতে বিকেন্দ্রীকরণের কোন উদ্যোগ নেই। নির্বাচনের ইশতেহারও থাকেনা এ সব নিয়ে কোন কথা। শুধু পরিবেশবাদীরাই চিৎকার করে এই শহরকে বাঁচাতে আর্তনাদ করছে। বাকিরা কেউ ভেবে দেখছে না কী চরম ভোগান্তির শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা। কবে আমরা জাগবো? আদৌও কী হুঁশ ফিরবে আমাদের? আপাতত সেই আশা দেখছি না আমি। কারণ এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যাক্তিরাই তো এখনো ঘুমন্ত।
লেখক: পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক
সারাবাংলা/এজেডএস