দাদা ভাই গণসূর্য্যের আলোয় জ্বলেছেন
১১ জুন ২০২৩ ০৩:৪০
সিরাজুল আলম খান পরলোক গমন করেছেন গত শুক্রবার। অবসান হয়েছে রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ এর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে ছোট্ট গ্রুপটি স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পটভূমি রচনা করেছে সেই গ্রুপের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান। কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে পাঁচজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয় যার অন্যতম কেন্দ্র ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ঘনিষ্ঠরা তাকে ডাকতেন ‘দাদা ভাই’ বলে। ১৯৬২-১৯৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়নের কারিগর হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সিরাজুল আলম খান সমকালীনদের কাছে স্বীকৃত। মুক্তি আন্দোলনের শেষের দিকে তিনি গড়ে তোলেন ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং বিএলএফ এবং সামরিক ইউনিট ‘জয় বাংলা বাহিনী’। বিএলএফ এবং জয় বাংলা বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য কি পরবর্তী সময়ের জাসদ তৈরির প্রথম ধাপ ছিল না?
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগের ছায়াতলে যে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য সিরাজুল আলম খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশ গঠনে কাজ না করে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের অধিক কালের নিজ নেতার নেতৃত্বকে ভুল দাবী করে, দলকে অস্বীকার করে, দলের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন উগ্র রাজনৈতিক এবং সন্ত্রাসধর্মী সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এক বছরের চেয়েও কম সময়ের মধ্যে কি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মত ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করা সম্ভব? বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী জাসদের উগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে লীগদের স্বাধীন বাংলাদেশে কথা বলার স্পেস তৈরি করে দিয়েছিল। জাসদের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকেরা আবার সংগঠিত হবার সুযোগ পেয়েছে; পাকিস্তান এবং আমেরিকাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। জাসদের কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি রচনা করেছে বলে মনে করেন সকল বাংলাদেশপন্থী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। নিন্দুকেরা তাকে বলেন, ‘কাপালিক বীর’।
১৫ আগস্টের পর সিরাজুল আলম খানের অনুসারী জাসদ নেতা কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধপন্থী সেনানায়ক খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজ বাহিনীসহ সমর্পিত হন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের অন্যতম জেনারেল জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অন্তর্গত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অংশের কাছে। খালেদ মোশাররফ এবং তার অনুসারীদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিধারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হাতে তুলে দেন দাদা ভাইয়ের শিষ্যেরা। দাদা ভাইয়ের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত শিষ্যদের ভুল রাজনীতিতে বাংলাদেশে পরিচালনার ভার শুধু স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতেই নয়, দীর্ঘ দিনের জন্য চলে গিয়েছিল স্বৈরশাসকদের এবং দাদা ভাইয়ের কথিত আদর্শ, সমাজতন্ত্র বিরোধী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে। পরবর্তী সময়ে দাদা ভাইয়ের শিষ্যদের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা লিপ্সার বেদীতে। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো বাঙালির ইতিহাসে কৃতঘ্নতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে।
২০১৬ সালে জাসদ নেতা মঈনুদ্দিন খান বাদল এর জাতীয় সংসদে দেয়া এক দীর্ঘ বক্তৃতায় এবং প্রায় একই সময়ে জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং কর্নেল তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের দৈনিক সমকালে লেখা নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদের রাজনীতি ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। দাদা ভাইয়ের শিষ্যগণ যে রাজনৈতিক আদর্শ বিবর্জিত ছিলেন তা আরও প্রমাণ করেছেন দাদা ভাইয়ের শিষ্য আ স ম আব্দুর রব এবং মেজর জলিল। মেজর জলিল জাসদ ত্যাগ করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করেন। তিনি হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে গঠিত সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন। প্রকৃত সমাজতন্ত্রী মৌলবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। দাদা ভাইয়ের আরেক শিষ্য আ স ম আব্দুর রব হয়েছিলেন এরশাদ আমলের গৃহপালিত প্রধান বিরোধী দলের নেতা। এখন তিনি রাজনীতি করেন স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-বিএনপি ঘরানায়। দুর্বল রাজনৈতিক আদর্শের কারণে জাসদ কখনো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় জাসদের ব্যর্থতার পর দাদা ভাইকে পাওয়া যায়নি প্রকাশ্য রাজনীতিতে। শোনা যায়নি তার মন্তব্য, বক্তৃতা। পড়া যায়নি তার রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে কোনো লেখা। এর পর থেকে তিনি রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’; বসবাস করেন রাজনীতির অন্তরালে। তিনি এতটাই নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন যে মৃত্যুর আগে তিনি তার পরিজনদের নির্দেশ দিয়েছেন মৃত্যুর পর তার মুখ কাউকে না দেখাতে। তার নির্দেশই পালন করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির অন্যতম নীতি নির্ধারক সিরাজুল আলম খানের আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে জাসদ গঠন অবাক করা বিষয় বৈকি! জাসদের প্রধান রাজনৈতিক চেতনা সমাজতন্ত্র যা তখন ক্রমক্ষয়মান ছিল। ৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগ সৃষ্ট প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবহে ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে শুধু সমাজতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে একটা দল গঠন যুক্তিযুক্ত নয়। কোনো প্রয়োজনও ছিল না। সমাজতন্ত্র নিজগুণেই বৈজ্ঞানিক। সমাজতন্ত্রের আগে ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটি যোগ করলে নতুন কোন মানে তৈরি করে না। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফসল নয়। এর কোনো তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও নেই। সে সময়ের বাস্তবতায় একটা সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করা কোন উদ্ভাবনী কাজও ছিল না। তাছাড়া আওয়ামী লীগেরও অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক চেতনা সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগ ত্যাগ অর্থহীন। বিশেষ করে দাদা ভাইয়ের মত প্রভাবশালী নেতার জন্য যিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকাল থেকেই আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রেখে আসছিলেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র শুধুই বাগাড়ম্বর।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তার যথেষ্ট প্রভাব থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে আওয়ামী লীগের তথা বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে হলো? আদর্শগত কোনো কারণে নয় নিশ্চয়ই। আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের প্রশ্রয়ে এবং দিগভ্রান্ত দেশীয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং এন্টি আওয়ামী লীগ শক্তিগুলোকে (১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ) একটি সম্মানজনক রাজনৈতিক লেবাসে আবৃত্ত করে (এ কথার মাধ্যমে এও বলতে চাইছি না যে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন) নিজেই একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন করে তার তাত্ত্বিক নেতা হয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী ধারার প্রাতঃস্মরণীয় নেতা হয়ে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে ঐতিহাসিক নেতা হয়ে থাকার সুযোগ ছিল। সুযোগটা তিনি নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের মত দলের ভেতরে থেকে তা সম্ভব ছিল না। এ ধারণা সঠিক হলে বলতে হয় যে তিনি রাজনৈতিকভাবে অতি উচ্চাভিলাষী ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময় ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, নীতি নির্ধারণে অংশ নিয়ে সিরাজুল আলম খান বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির জন্য যে ধনাত্মক ভূমিকা রেখেছিলেন তা আর দেখা যায়নি স্বাধীনতার পর। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলো পায়নি পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি। চলমান রাজনীতি নিয়ে কেউ শোনেনি তার পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, সমালোচনা কিংবা দিক-দর্শন। জাসদের ব্যর্থতার পর তিনি পর্দার অন্তরালে থেকে রাজনীতির কলকাঠি নেড়েছেন বলে আলোচনা আছে রাজনীতি মহলে। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে তিনি জেনারেল এরশাদের এবং এরশাদ পতনের পর এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম প্রধান আসামী, জিয়া তনয় তারেক রহমানের গোপন উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন বলে রাজনীতি পর্যবেক্ষকেরা বলে থাকেন। এরশাদ এবং তারেককে পরামর্শ দিয়ে তিনি দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছেন? এরাও কি রাজনৈতিকভাবে জাসদের মতই ব্যর্থ নয়?
প্রকৃতপক্ষে মুক্তি সংগ্রামের পর সিরাজুল আলম খানের কোন রাজনৈতিক অর্জন নেই। তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বলয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন থেকে তিনি জাতির জন্য কিছু দিতে পারেননি। দূর থেকে একটা গ্রহ বা উপগ্রহকে যেমন নক্ষত্রের আলোতে আলোকিত দেখায় তিনিও তেমনি বঙ্গবন্ধুর আলোতে উজ্জ্বল ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আলোতে আলোকিত ছিলেন। তিনি নিজেই যখন সে আলো থেকে নিজেকে বিচ্যুত করলেন তখন থেকে তিনি আর আলো ছড়াতে পারেননি। তিনি নক্ষত্র নন, ছিলেন নক্ষত্রের উপর নির্ভরশীল।
লেখক: চার্টার্ড একাউন্টেন্ট; অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/আইই