যেভাবে ‘জঙ্গিরাষ্ট্র’ বানানোর ষড়যন্ত্র ঠেকাল বাংলাদেশ
১ জুলাই ২০২৩ ১৪:৩৪
পহেলা জুলাই ২০১৬ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে একটি নজিরবিহীন দিন। এটি নিছক কোনো ঘটনা ছিল না। এটি ছিল সরাসরি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা, সর্বোপরি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে হিসেবে পরিচিত করার লক্ষ্যই ছিল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর টার্গেট।
বাংলাদেশে একসময় জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছিল। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদকে লালন-পালন করা হয়। জেএমপি, হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা মসহ আরো অনেক নামে জঙ্গিরা সারা দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এদেশে ২১ শে আগস্ট ও ১৭ আগস্টের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিরা কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে আবার জঙ্গিরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় চলে আসে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা। এই হামলার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। এটি শুধুমাত্র একটি বেকারিতে হামলা নয়, এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর সরাসরি আঘাত।
ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশান-২ এ ৭৯ নম্বর রোডের শেষ প্রান্তে লেকের পাশে হোলি আর্টিজান বেকারি অবস্থিত। কুটনৈতিক পাড়ায় অবস্থিত বলে বিদেশিদের কাছে এ জায়গাটি খুবই জনপ্রিয় ছিল।
সেদিন পাঁচ তরুণ পিস্তল, সাব মেশিন আর ধারালো অস্ত্র হাতে রাত পৌনে ৯ টার দিকে বেকারিতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। প্রথমেই গুলশান থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ এগিয়ে আসে। তারপর গুলশান জোনের সব থানার কর্মকর্তারা অংশ নেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে বুঝে ডিএমপি কমিশনার, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান, র্যাব প্রধান ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয়ে অভিযান তত্ত্বাবধান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক, বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সিলেটে অবস্থানরত প্যারা কমান্ডোদের জরুরি ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন। সারারাত জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হলেও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তারপর ২ রা জুলাই ভোর ৭ টা ৪০ মিনিটে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে অপারেশন ‘থান্ডারবোল্ট’-এর মধ্য দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটে জিম্মিদের মুক্ত করা হয় এবং হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গিকে হত্যা করা হয়।
জঙ্গিদের হামলায় ১৮ জন বিদেশি নাগরিক সহ ২২ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে নয় জন ইটালির, সাত জন জাপানের, তিন জন বাংলাদেশি (যাদের একজন দ্বৈত নাগরিক), একজন ভারতীয় নাগরিক, এছাড়া হামলায় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিনসহ ঢাকা মহানগর উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের অ্যাডিশনাল কমিশনার রবিউল করিম জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন।
জাপানের নিহত সাত নাগরিকই ছিলেন মেট্রোরেল প্রকল্পে সাথে জড়িত। এ ঘটনার পর জাইকা তাদের কাজও বন্ধ করে দেয়। তারপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সাথে জাইকার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ ও জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনার পর আবার কাজ শুরু করে। এ প্রসঙ্গে জাপান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই অবস্থায় বাংলাদেশে কাজ বন্ধ করা হলে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীকে সমর্থন করা হয়। এটা হবে সন্ত্রাসীদের কাছে নথি স্বীকার করা। যা তারা কখনোই করতে পারেন না। জাইকার সাথে সাথে অন্য দাতারাও ফিরে আসেন।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তৎকালীন প্রধান মনিরুল ইসলাম এ হামলার কারণ সম্পর্কে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করা, বাংলাদেশকে জঙ্গি-রাষ্ট্র বানানো, সরকারকে কোনঠাসা করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করা, দেশে অস্থিতিশীল করে বিনিয়োগ বন্ধ করা, বিদেশিদের হামলা করে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প গুলো বন্ধ করা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজেদের শক্তিমত্তা তুলে ধরাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
বিশ্বব্যাপী অনেক বড় বড় জঙ্গি সংগঠন আছে। তাদের হাতে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং বিপুল অর্থ। তাই নব্য জেএমবির উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সংখ্যক বিদেশিকে হত্যা করা যাবে, তত বেশি আন্তর্জাতিক প্রচারে আসতে পারবে। একারনেই হলি আর্টিজানকে বেছে নিয়েছে। এটি কুটনৈতিক পাড়ায় অবস্থিত বলে এখনকার বেশিরভাগ গেস্টই থাকেন বিদেশিরা।
নব্য জেএমবির প্রধান তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। তবে হামলাকারিদের কারো সাথে ইসলামিক স্টেট(আইএস) কিংবা আল-কায়দার সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না।
তদন্তে বের হয়ে আসে, জঙ্গিরা বেকারিতে অবস্থিত শ্রীলঙ্কান এক নাগরিকের মোবাইল ফোন নিয়ে বাইরে থাকা জঙ্গিদের সাথে ইন্টারনেটে যোগাযোগ রেখেছিল। সেখান থেকেই পাঠানো হয়েছিল রক্তাক্ত লাশের ছবি। এই রক্তাক্ত ছবি গভীর রাতে আইএসের মুখপত্র ‘আমাক’-এ প্রকাশ করে দায় স্বীকার করে। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুলোতে প্রকাশ পায়। কিন্তু এ ঘটনার সাথে আইএসের সম্পৃক্ততা কখনো কোনো ভাবেই পাওয়া যায়নি।
হলি আর্টিজানে হামলার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। হামলার ২৫ দিন পর কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ি নামে পরিচিত একটি ভবনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে নয় জঙ্গি নিহত হয়। একে একে নারায়নগঞ্জে, গাজীপুর, সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২৫টি স্থানে জঙ্গিদের উপর হামলা চালানো হয়। এসব হামলায় ৬৩ জন নিহত এবং কয়েক’শ গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য য়ে, এসব অভিযানে হলি আর্টিজানের মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীও নিহন হয়। মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিল, এ হামলায় ২১ জন সম্পৃক্ত ছিল। তাদের মধ্যে ওই দিন ঘটনাস্থলে নিহত হয়, পরে বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটজন নিহত হয়, বাকি আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
হলি আর্টিজান ঘটনার পর সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপে মানুষ সচেতন হয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বেশি করে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষই উগ্রপন্থিদের বিষয়ে জনগণকে তথ্য দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে তথ্য পেতে র্যাব চালু করেছে ‘রিপোর্ট টু র্যাব’ এবং কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চালু করেছে ‘হ্যালো সিটি’ নামে পৃথক অ্যাপ। এছাড়াও জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে তথ্য দেওয়ার সুযোগ তো আছেই।
সরকারে পাশাপাশি জনগণ যত বেশি সচেতন হবে জঙ্গিবাদের ‘মূলোৎপাটন’ ততই সম্ভব হবে। সরকারে জঙ্গিবাদ বিরোধী নানা তৎপরতায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও জঙ্গিবাদ বিরোধী সচেতনতা তৈরি হয়েছে। যার কারণে জঙ্গিরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। জঙ্গিরা এখন ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য নিরাপদ আস্তানা খুঁজে পাচ্ছে না। এখন ভাড়াটিয়াদের তথ্য বাড়ির মালিকদের নিকটস্থ থানায় জমা দিতে হয়।
সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যালে আট আসামীর ৭ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘—-কলঙ্কজনক এই হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টা করা হয়।’ তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের রায় কার্যকর সম্ভব হয়নি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সারারাত নির্ঘুম থেকে সমস্ত পরিস্থিতি মনিটরিং করেছেন। অভিযানের সফল সমাপ্তির পর ২ রা জুলাই রাতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি, বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যার সুফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো জায়গায় আছে। জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল হয়ে গেছে সেটা হয়তো বলা যাবে না, তবে সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ে তাদের শক্তি কমেছে। এবং অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে এটা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার মত-দ্বিমত যেভাবে ‘জঙ্গিরাষ্ট্র’ বানানোর ষড়যন্ত্র ঠেকাল বাংলাদেশ