ডলারকে আর্থিক অস্ত্রে ব্যবহার কতটা যৌক্তিক?
১২ জুলাই ২০২৩ ১৪:৫৯
রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বজুড়ে ডলারের দামে অস্থিরতা চলছে। এ থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। এই সময়ে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। ফলে ডলারের জোগান দিতে গিয়ে চাপ পড়ছে রিজার্ভের ওপর। রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার ব্যাংকিং খাতের ব্যর্থতাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নিয়ে সংশয়ের জন্ম দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন ইনোডো ইকোনমিক্স সংস্থার অর্থনীতিবিদ ডায়ানা চয়লেভা। ২০১১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দেনা বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে গেছে ৩১ লাখ কোটি ডলার। নতুন করে আরো দেনার বোঝা বাড়ানোর বিরোধী রিপাবলিকানরাই এখন কংগ্রেস বা প্রতিনিধি পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মার্কিন জনতার মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে ৪০ শতাংশ। ফলে অর্থনীতির এই খেলায় নামার রাজনৈতিক পুঁজিও তার নাই। ফেডের মুদ্রানীতির কারণে মার্কিন অর্থনীতিও ভুগছে। যেমন-উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকারী প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। আর্থিক খাতের ভার সামলাতে ফেড-ই যথেষ্ট। বাইডেন প্রশাসনের এমন ধারণা হয়তো মুদ্রার সরবরাহ দিকের কার্যকারিতাকে ঘিরে দেখা দেওয়া সংকটকে ঘনীভূত করছে।
বর্তমানে এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চীন তার সম্পদের ভান্ডারে মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটির পরিমাণ ও কমাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে মার্কিন ডলারের অংশ কমিয়ে চলেছে চীন। রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যে ও রমরমা বাড়ছে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের। এই বাস্তবতায় ডলারের ক্রমাগত পতনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিনা তেমন প্রশ্ন তোলা অর্থনীতিবিদদের সংখ্যাও বাড়ছে। ইউয়ানের এই সুহাল কেন? এবং ডলারের কেন দুর্দিন তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার শেষ নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টি বেশি বলা হচ্ছে তা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটকালে ডলারকে আর্থিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা এবং বৈশি^ক মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ইচ্ছানুসারে নিয়ন্ত্রিত করার উদ্যোগ। যেমনটা উল্লেখ করেন আর্থিকখাতের বৃহৎ বিনিয়োগ সংস্থা মিলেনিয়াম ওয়েক অ্যাডভাইজরস এর কৌশলবিদ জল মলডিন। তার মতে, এর ফলে অমার্কিন বিনিয়োগকারী ও সরকারগুলো তাদের সম্পদ ভান্ডারকে বহুমুখী করণের উদ্যোগ নেবে, সরে আসবে মার্কিন ডলার থেকে যা এতদিন সম্পদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবেই পরিচিত ছিল।
আমরা দেখতে পাচ্ছি ওপেক প্লাস জোটে রাশিয়ার প্রভাব বেড়েছে, সৌদি আরবের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক গভীর হয়েছে মস্কোর, অন্যদিকে ইরানের সাথে চীনের সম্পর্ক এখন দৃঢ়তর। তাই জ্বালানি বাণিজ্যে ইউয়ান-ভিত্তিক লেনদেন পেতে পারে নতুন মাত্রা। তেল উৎপাদক প্রধান প্রধান দেশগুলো ইউয়ানকে মান্যতা দিলে ডলারের শক্তিহানী ঘটবে। তাইওয়ান নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের উত্তেজনা চরমে। কট্টর পশ্চিমাপন্থী তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন এর সাথে শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা দেখা করেছেন। আমেরিকা দিচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা। ফলে সামরিক সংঘাতকে বাদ দিলে একমাত্র আর্থিক যুদ্ধের রাস্তাই খোলা চীনের সামনে ডলারকে দুর্বল করার উদ্যোগ নিয়ে বেইজিং এক মোক্ষম জবাব দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বের পাঁচ দেশের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ‘হাই ভ্যালু কারেন্সি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের ইউয়ান সেগুলোর অন্যতম। আইএমএফের কারেন্সি বাস্কেটে ইউয়ান স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৬ সালে। এরপর থেকে সংস্থাটির পর্যালোচনায় মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, চীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তিশালী অর্থনীতি। তাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও বেশ ভালো এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের শক্তিশালী বানিজ্যিক সম্পর্ক আছে। ফলে, চীনের মুদ্রার ওপর ভরসা করা যায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেন বাড়ছে। ব্লুমবার্গের ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তথ্য উপাত্তে দেখা যায় রাশিয়ার বাণিজ্যে প্রথম বারের মতো ডলারকে ছাড়িয়েছে চীনের ইউয়ান। এমনকি চীন-রাশিয়ার বাণিজ্যেও ৭০ শতাংশের বেশি হচ্ছে এখন স্থানীয় মুদ্রায়। অনেক দেশই এখন রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের বিকল্প ইউয়ানসহ অন্যান্য মুদ্রাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ও ডলারের অবস্থান ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। ২০০০ সালে যেখানে বিশে^র বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রার ৭০ শতাংশ ছিল ডলার। এখন তা কমে ৬০ শতাংশের নীচে নেমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইএমএফ সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে বিশ্বে রিজার্ভ মুদ্রার ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছিল ডলার। ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল ইউরো ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ জাপানি ইয়েন, ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ পাউন্ড স্টার্লিং, ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ চীনা ইউয়ান, ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ কানাডিয়ান ডলার, শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ সুইস ফ্রাঁ এবং ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ অন্যান্য মুদ্রা।
এ দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ^ মুদ্রা ব্যবস্থায় যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তাতে দিন দিনই ডলারবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে অনেক দেশ বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যে, আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিশর ব্রিকসভূক্ত দেশ চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে ডলার বাদ দিয়ে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পন্ন করতে চায়। ব্রিকসভূক্ত ৫টি দেশে রয়েছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ এবং বিশ্ব অর্থনীতির তিন ভাগের এক ভাগ। এমনকি ব্রিকস জোটে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে আরও ২৫টি দেশ। এতে ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হবে ৩০টি। বিশ্লেষকরা বলছেন ব্রিকসের দেশগুলো যদি এক সঙ্গে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করে তবে বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় আরেকটি শক্তিশালী মুদ্রার উত্থান ঘটবে। যা ডলারকে টালিয়ে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জোটের বাইরে নতুন অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে বাংলাদেশও যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ব্রিকস জোটে যোগ দিলে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে এবং ভবিষ্যতে বিকল্প মুদ্রা বা বিকল্প বাণিজ্যিক ব্যবস্থা চালু করলে এক্ষেত্রে সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদগণ। পক্ষান্তরে, এটাও ঠিক যে, ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ ঘটবে। তাই এ জোটে যোগ দিলে আমাদের অর্থনৈতিক সুবিধা কতটুকু থাকবে তা ভবিষ্যতে আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের ওপরই নির্ভর করবে।
তাই আগামী আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় ওই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো নিজেদের বাণিজ্যিক পরিশোধ কিভাবে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় করবে এ নিয়ে আলোচনা করা হবে। ফলে শুধু বেইজিং আর মস্কো নয় ভারত থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন ডলারমুক্তকরণে ঝুঁকছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলার শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাই বিশেষত রাশিয়া ও চীন এই মুদ্রা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের জুলিয়াস সেন বলেন, ডলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ফলে যে দেশ টার্গেটে পরিণত হয় সেই দেশটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে এটি সবার জন্য ক্ষতিকর।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ডলারকে আর্থিক অস্ত্রে ব্যবহার কতটা যৌক্তিক মত-দ্বিমত রজত রায়