প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ ও উচ্চশিক্ষায় এর প্রভাব
১১ জুলাই ২০২৩ ১৩:৫০
‘শিক্ষাই সব শক্তির মূল’- ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের এই বাণীটি চারশো বছরের পুরনো। প্রবাদ বাক্যটি শত শত বছর পরেও সমান প্রাসঙ্গিক, একই মূল্য বহন করে। শিক্ষা ব্যতীত কোনো ধরণের অগ্রগতি কল্পনাও করা যায় না। শিক্ষাকে আখ্যায়িত করা হয় একটি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে। বাংলাদেশে যে ৫টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছে, গ্রহণ করেছে নানা কার্যকরী পদক্ষেপ। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। আফ্রিকা বা অনগ্রসর দেশগুলো যখন শিক্ষায় ছেলেমেয়ের সমতা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরেই সেই সমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছাত্রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে। শিক্ষায় দৃশ্যমান সাফল্য বাংলাদেশ সরকারের একটি বড় অর্জন; এই অনন্য অর্জন এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নয়নের এক রোল মডেল। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। বর্তমান সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২’ প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’। শিক্ষায় সরকারের আর ও একটি অন্যতম সাফল্য জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করা।
বাংলাদেশকে এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিদ্যুৎসহ গত এক যুগে দেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলা হচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশ চাঁদে যাবে, উড়োজাহাজ বানাবে, এমন স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার্থীদের অর্থের দিকে না ছুটে জ্ঞানার্জনে মনোনিবেশ করতে হবে।সেই লক্ষ্যে বর্তমানে দেশে অনেক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছে, এমনকি অ্যারোনটিক্যাল সেন্টারও করা হয়েছে।বিশ্বব্যাপী শীর্ষ র্যাঙ্কিংয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের জন্য ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ১০ জনকে পিএইচডি ফেলোশিপ এবং ৩৮ জনকে মাস্টার্সের ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপের (পিএমএফ) ফেলোসহ উচ্চ শিক্ষার্থীদের দেশের ব্যাপক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য দেশী ও বিদেশী শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাভাবনা প্রয়োগের আহ্বান করা হয়।আমাদের দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আমরা কখনোই অন্যের মডেলের ওপর নির্ভর করব না। দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে আমরা নিজস্ব মেধা ও চিন্তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসবে, সেজন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, কোনোমতে পিছিয়ে থাকা যাবে না, এটাই আমাদের লক্ষ্য। সকল খাতে সম্পদের সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী এই পিএমএফ চালু করেন। জিআইইউকে পিএমএফ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । সরকারি কর্মকর্তা বিসিএস ও নন বিসিএস এবং বেসরকারি প্রার্থী এই তিন ভাগে বৃত্তিটি প্রদান করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বৃত্তি পাওয়া এসব ফেলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে।বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য এ পর্যন্ত ২৭৭ জন কে মাস্টার্স এবং ১০৮ জনকে পিএইচডি ফেলোশিপ প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ, দেশবাসীর মানসিকতা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ফেলোদের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে। প্রথমত আমাদের দেশকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং অনুভব করতে হবে যেখান থেকে জ্ঞান অর্জন করা যায়। দেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করতে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জ্ঞানের সঙ্গে দেশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার জ্ঞানকে সমন্বয় করতে হবে যা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। জনগণের অর্থে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে জনগণ ও দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রতিটি খাতে উন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকার পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। সঠিক পরিকল্পনা যে দেশকে সার্বিক উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে তা গত সাড়ে ১৪ বছরে তা বর্তমান সরকার প্রমান করেছে। বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এটি আমাদের লক্ষ্য এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পিছিয়ে পড়া চলবে না। মেধাবীরা তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে।
বর্তামন সরকার দেশে উচ্চশিক্ষা প্রনয়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ডিজিটাল, ইসলামি-আরবি, টেক্সটাইল, মেরিটাইম, এভিয়েশন অ্যারোস্পেস, বেসরকারি ফ্যাশন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশেয়ায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কারণ শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি ও উন্নতি সম্ভব নয়। ২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে বর্তমান সরকার। শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য ফেলোশিপ প্রদানসহ সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার মেরিটাইম, অ্যারোস্পেস, এভিয়েশন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মতো বিভিন্ন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষাকে বহুমাত্রিক করেছে। সরকার গবেষণা ও বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং উচ্চ শিক্ষার্থীদের গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে দেশের খাদ্যকে পর্যাপ্ত করে তুলা হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা খুবই কম। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমাদের আরও গবেষণা প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলা হবে এবং আজকের তরুণরাই হবে স্মার্ট দেশ গড়ার সৈনিক। দেশের উন্নয়নের অদম্য গতি কেউ থামাতে পারবে না। বাংলাদেশ চাঁদে যাবে, উড়োজাহাজ বানাবে, এমন স্বপ্নও একদিন বাস্তবায়ন হবে।
শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের অর্জন বিপ্লবের প্রতিরূপ। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে সফলতার যে প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছে ভবিষ্যতেও তা বলবত থাকবে বলেই আশা করা যায়। ২০৪১ সালের মধ্যে আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আকাঙক্ষায় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, তথাপি বিকল্প নেই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রযাত্রায় জননেত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা অগ্রগণ্য হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে আনন্দনিকেতন, সেই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি। তাই জোর দিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্যের আসল কারিগর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশকে অবৈধ সামরিক জান্তা সরকার এবং তার ভূমিষ্ঠ দল যেভাবে অগ্রগতির ধারাকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সব কিছু ভেঙে চুরমার করেছিলো, সেই ভঙ্গস্তুপের ওপর থেকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আজ রোল মডেল হিসেবে বিশ্বের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ ও উচ্চশক্ষিায় এর প্রভাব মত-দ্বিমত