হামলাকারীরা গণতন্ত্রের শত্রু
১৮ জুলাই ২০২৩ ১৮:২৫
চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যুতে শূন্য হয় ঢাকা-১৭ আসনটি। এখন রাজনীতির সব আলোচনা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে হলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন করতেই হয় নির্বাচন কমিশনকে। ফারুকের মৃত্যুতে শূন্য হওয়ার পর বিনোদন জগতের অনেকেই এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মাস পাঁচেকের জন্য হলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে আগ্রহী লোকের সংখ্যা কম ছিল না। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় মোহাম্মদ এ আরাফাতকে। উচ্চশিক্ষিত, পরিশীলিত, যুক্তিবাদী আরাফাতের মনোনয়ন আমাকে বেশ স্বস্তি দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও আরাফাত নানা গবেষণা কাজের সাথে জড়িত। সর্বশেষ কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হলেও তিনি অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগের বৃদ্ধিবৃত্তিক অংশের সাথে ঘনিষ্ঠ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টক শো’তে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেন তিনি। আরও অনেকের মত মেঠো বক্তৃতা বা গলাবাজী তার স্বভাব নয়। তিনি কথা বলেন যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে, পরিসংখ্যান দিয়ে। মোহাম্মদ এ আরাফাতকে ভালো লাগার আরেকটি বিশেষ কারণ আছে। রাজনৈতিক মহলে সবাই জানেন, মোহাম্মদ এ আরাফাত প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু এই বন্ধুত্বের কোনো ফায়দা তিনি কখনও নেননি। ঘোর শত্রুও তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা অসততার অভিযোগ আনতে পারবে না। এই বাংলাদেশে এর আগেও আমরা প্রধানমন্ত্রীপুত্রের বন্ধুর দাপট দেখেছি। তাই মোহাম্মদ এ আরাফাতের লো-প্রোফাইলে থাকা বাংলাদেশের বিবেচনায় ব্যতিক্রমই। তেমন একজন ক্লিন ইমেজের মানুষকে মনোনয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একটা বার্তাও দিয়েছে।
যথারীতি বিএনপিসহ মাঠের বিরোধীদলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেছে। জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি মনোনয়ন দিলেও নির্বাচনের মাঠে সবাইকে ছাপিয়ে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন আশরাফুল আলম, যিনি হিরো আলম হিসেবেই দেশজুড়ে পরিচিত। নির্বাচনে মোহাম্মদ এ আরাফাতের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিরো আলম, এটা রাজনীতিতে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। অনেকে এটাকে বলছেন, গণতন্ত্রের জন্য লজ্জা, গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক। কিন্তু আমি এটাকে দেখেছি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য হিসেবে। গণতন্ত্রে সবাই সমান। সবার সবার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার আছে। জনগণ বেছে নেবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে। কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর কে ইউটিউবার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে এটা কোনো বিবেচনা নয়। ঢাকা-১৭ আসনের একজন উচ্চশিক্ষিত পিএইচডিধারী ভোটার, যিনি বিএনপি সমর্থক; তিনি কিন্তু হিরো আলমকেই ভোট দিয়েছেন। এটাই মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা। ভোটের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটা ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হিরো আলমের সাথে লড়তে হচ্ছে, এটাই লজ্জার। এসবও বলাবলি হচ্ছিল, আওয়ামী বিরোধী সব ভোট হিরো আলম পাবেন এবং তাতে তিনি জিতেও যেতে পারেন। কিন্তু ভোটের পরে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী বিরোধী ভোটাররা কেন্দ্রেই যাননি, এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটাররাও যাননি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ফলাফল কী হবে জানি না, তবে ঢাকা-১৭ আসনে মোহাম্মদ এ আরাফাতই জয়ী হয়েছেন। তবে এই নির্বাচনে গণতন্ত্রের আরেকটা সমস্যা সবাইকে ভাবিয়েছে। ঢাকা-১৭ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। তাদের মধ্যে ভোট দিতে এসেছিলেন মাত্র ৩৭ হাজার ৪২০ জন। শতকরা হিসেবে মাত্র ১১.৫১ শতাংশ। ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আরাফাত। যথারীতি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম, যিনি ভোট পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট। সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী সিকদার আনিসুর রহমান পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৩২৮ ভোট। ভোট যাই পান, আরাফাত এখন ঢাকা-১৭ আসনের এমপি। এটাই গণতন্ত্রের বিপদ। মোহাম্মদ এ আরাফাত মোট ভোটের মাত্র ৯ শতাংশ পেয়েছেন। তার মানে যুক্তির খাতিরেও বলা যায়, গুলশান-বনানী এলাকার ৯১ ভাগ মানুষ তাকে ভোট দেয়নি। ৯১ ভাগের ভোট না পেয়েও আরাফাত এমপি। আবার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য হলো, মাত্র ৯ ভাগের ভোট পেলেও আরাফাত কিন্তু এখন সবার এমপি। যারা ভোট দিয়েছে, যারা ভোট দেয়নি; সবার প্রতিনিধি তিনি।
দিনভর ঢাকা-১৭ আসনের মূল আলোচনা ছিল ভোটার নিয়েও। অনেক কেন্দ্র ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাঁকা ছিল। অনেক কেন্দ্রে দিনের বেশির ভাগ সময় ভোটারের চেয়ে এজেন্টের সংখ্যা বেশি ছিল। পাঁচ মাসের জন্য এমপি নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা তাদের দলের সমর্থকদেরও কেন্দ্রে আসার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অনেকে বলছেন, ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের ভোট এই ২৮ হাজারই। তর্কের খাতিরে বলতে হয়, তাহলে এই আসনে আওয়ামী বিরোধী ভোট ৫ হাজার। এসবই কুতর্ক। ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল না, দিন শেষে এটাই বাস্তবতা। গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকার মানুষেরা মুফতে পাওয়া ছুটিটা উপভোগ করেছেন।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দলের মধ্যে ভালো নির্বাচন করার একটা তাগিদ আছে। দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটা প্রমাণের জন্য মরিয়া তারা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির পর অনুষ্ঠিত ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মানে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কদিন আগে ঘুরে যাওয়া মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার গুরুত্বপূর্ণ সফরেরও মূল ফোকাস ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচনী প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের উপস্থিতিতে একটি শান্তিপূর্ণ ও ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় একটা সুযোগ ছিল। ভোটার কম হলেও দিনভর নির্বাচনী পরিবেশ ভালোই ছিল। কিন্তু শেষ বেলায় সব উল্টে গেল। বেলা সোয়া তিনটার দিকে বনানী বিদ্যানিকেতন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম। সেখানে তিনি একটি নারী ভোটকেন্দ্রে যান। এ সময় নৌকা প্রতীকের কর্মী ও সমর্থকেরা পেছন থেকে তার উদ্দেশে গালিগালাজ করতে থাকেন এবং কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে কেন্দ্রটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা হিরো আলমকে ঘিরে রেখে স্কুলের ফটকের দিকে নিয়া যান। তখনো পিছু নেন তারা। স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে বেরোনোর পরে হিরো আলমের পাশে পুলিশ সদস্যরা ছিলেন না। একপর্যায়ে নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেন এবং এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করেন। তাদের মূল ক্ষোভ হলো, হিরো আলম কেন গুলশান-বনানী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছে। তিনি কি এমপি হওয়ার যোগ্য। তিনি একজন টিকটকার, জোকার। তিনি কি এমপি শব্দের অর্থ জানেন!
হামলাকারীরা যে আওয়ামী লীগের সমর্থক এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভিডিও ফুটেজ দেখে সবাইকে সনাক্ত করাও সম্ভব। আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক হলেও তারা যে আওয়ামী লীগের কত বড় ক্ষতি করলেন, এটা তারা বুঝতেও পারেননি, হয়তো পারবেনও না। এমনিতেই একতরফা নির্বাচন। হিরো আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় তবু নির্বাচন নিয়ে কিছুটা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের চর্চার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ কর্মীরা কি তাহলে এখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকেই সহ্য করবেন না। হিরো আলম মাঠে না থাকলে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেই কি তারা খুশি হতেন? মুখে গণতন্ত্রের কথা বলবেন, মাঠে কাউকেই সহ্য করবেন না, এই অতি উৎসাহী সমর্থকরাই নৌকা ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। হামলাকারীরা শুধু আওয়ামী লীগের শত্রু নন, গণতন্ত্রের শত্রু।
আরাফাত এই হামলার ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত বলেছেন। দায়ীদের শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি যতটুকু চিনি, এই হামলার ঘটনা আরাফাতকে বেদনার্ত করবে। এমনিতেই ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে তার মন খারাপ থাকার কথা। হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা তার বিজয়কেই কলঙ্কিত করবে। রিটার্নিং অফিসার, নির্বাচন কমিশনারও হামলার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে দায়ীদের শাস্তির কথা বলেছেন। এরই মধ্যে পুলিশ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখন যত চেষ্টাই করুন ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে, এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। শেষ সময়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সামনে এই হামলার ঘটনা আওয়ামী লীগকে অনেকটাই পিছিয়ে দেবে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়, বিরোধী দলের এই দাবিকে আরো যুক্তি দেবে এই হামলা। হিরো আলম এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। তার ওপর হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিঙেও উঠে এসেছে হিরো আলম প্রসঙ্গও।
হিরো আলমের ওপর হামলার সময় হামলাকারীদের এক সঙ্গীকে বলতে শোনা যায়, মারিস না, মারিস না, বদনাম হবে। একজন সেটা বুঝলেও বাকিরা হিরো আলমকে মেরে আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেললেন, গণতন্ত্রকে ঝুঁকির মুখে ফেললেন। আগামী নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগকে দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অতি উৎসাহীদের চিহ্নিত করে দল থেকে বের করে দিতে হবে। নইলে আগামী নির্বাচনে বিপর্যয়ই অপেক্ষা করছে শুধু।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই