বঙ্গমাতা মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ
৮ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৪১
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, দেশরত্ন শেখ হাসিনার মা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সকল লড়াই, সংগ্রাম আন্দোলনের নেপথ্যের শক্তি, সাহস, অনুপ্রেরণা। বঙ্গমাতা ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি শত প্রতিকূলতায়ও বঙ্গবন্ধুকে নিরাশ করেননি বরং সাহস যুগিয়েছেন। কখনো বলেননি তুমি রাজনীতি করোনা, তুমি জেলে গেলে আমাদের কি হবে, বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ কি হবে। বরং উল্টোটা বলেছেন, তুমি দেশের জন্য কাজ করো। আমাদের জন্য ভেবোনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতার ভুমিকা অপরিসীম। ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনার দিকে তাকালে বেগম মুজিবের অবদান আরো স্পষ্ট হবে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। তখন বাড়িতে বেগম মুজিব অসুস্থ ছিলেন। তারপরও নিজেকে দেখতে স্বামীকে বাড়িতে আসার কথা না বলে চিঠি লিখে বলেছেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজ করে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ওপর আমার ভার ছেড়ে দেন। ’এঘটনা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে, তখন মাত্র ১৬ বছর বয়সে এই ভাবে স্বামীকে দেশের কাজ করার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেওয়ার পর পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে আটক করে, যেতে হয় কারাগারে। ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও ৬-দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালনে বেগম মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তখন গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে তাঁদের ছোট ফুফুর বাসায় চলে যেতেন। সেখান থেকে কাপড়, স্যান্ডেল পরিবর্তন করে বোরকা পড়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের কাছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পৌঁছে দিতেন। আন্দোলন কিভাবে চলবে সেবিষয়ে ছাত্রনেতাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও আন্দোলন পরিচালনার নিজের গয়না বিক্রি করেও তাদের হাতে কিছু খরচাপাতিও তুলে দিতেন।
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে, মুক্তির দাবিতে সারা পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে উত্তাল। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইয়ুব খান গোল টেবিল আলোচনার মাধ্যমে কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। সিন্ধান্ত হয় শেখ মুজিবকে আলোচনার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হবে। আওয়ামী লীগের নেতারাও মুক্তির বিষয়ে সবাই ঐক্যমত্য। কিন্তু বেঁকে বসেন একজন, তিনি বেগম মুজিব। তিনি মনে করলেন, প্যারোলে মুক্তি নেওয়া ঠিক হবেনা। মুক্তি হলে অবশ্যই নিঃশর্ত হতে হবে। এবিষয়ে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেছেন, মা আমাকে চিরকূট দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে পাঠালেন। কি বলতে হবে শিখিয়ে দিলেন। ‘বেগম মুজিবের নির্দেশ, জনগণ তোমার সাথে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নিবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবিষয়ে আরো বলেন, পিতার কাছে মায়ের বার্তা পৌঁছে দিয়ে ফেরার পর অনেক নেতারা বলেছিলেন, তুমি কেমন মেয়ে, বাবার মুক্তি চাও না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেদিন বঙ্গমাতার একটি সিন্ধান্তই শেখ মুজিব থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুতে পরিনত হয়েছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিবেন। সেদিকে তাকিয়ে পুরো দেশ। ছাত্র-যুবকরা চাচ্ছে আজই স্বাধীনতা ঘোষনা করুক বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সরকার বঙ্গবন্ধুকে বিছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে গ্রেফতার এবং পুরো রেসকোর্স ময়দানে ধ্বংস লীলা চালাবে। এমন চিন্তায় বঙ্গবন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এমন সময় এগিয়ে আসেন বেগম মুজিব। তিনি বলেন, ‘মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের হাতে বাঁশের লাঠি। এই মানুষ গুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে বাড়ী ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শের দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করো, কাজেই কি বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শোনার দরকার নেই। এই মানুষগুলির জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা। ‘বঙ্গমাতার এই কথা গুলো বঙ্গবন্ধুর কাছে টনিক হিসেবে কাজ করেছে, দিলেন ইতিহাস সেরা বক্তব্য। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটা বলেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। একদিকে লক্ষ লক্ষ জনতা যা বোঝার বুঝে গেলো, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকরাও বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দোষারোপ করতে পারলো না।
বঙ্গমাতাও বঙ্গবন্ধুর মতো সবসময়ই বাংলাদেশকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। এজন্যই পাকিস্তানিদেরকে সবসময় এড়িয়ে চলতেন। ধানমন্ডির বাড়িতে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নেতারা আসতেন কিন্তু তিনি কখনো তাদের সামনে আসতেন না। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন, তাদেরকে বলতেন আমি পর্দা করি। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ ছিলেন, অনেক বার পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন, কিন্তু বঙ্গমাতা একদিনও সেখানে যাননি, যেতেও চাননি। তিনি মনে প্রানেই পাকিস্তানিদের ঘৃণা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ অবশ্যই একদিন স্বাধীন হবে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব খুনিদের কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চান নি। নিজেকে বাঁচানোর একবারও চেষ্টা করেন নি। বরং সাহসের সঙ্গেই বলেছেন- আমার স্বামীকে হত্যা করেছো, আমি তার কাছেই যাব।’ তারপর খুনিরা সেখানেই বঙ্গমাতাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। জীবনে যেমন বঙ্গবন্ধুর সাথে ছায়াসঙ্গী ছিলেন, ঠিক মরণেও উপযুক্ত সঙ্গী হয়ে চলে গেলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে আজীবন ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে আজীবন ছিলেন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যেমন পরিবারের হাল ধরেছেন ঠিক তেমনি অতন্দ্র প্রহরীর মতো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গমাতা ছিলেন একজন মহীয়সী নারীর প্রতিকৃতি। বঙ্গমাতাকে ছাড়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এত বড় বড় সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া কখনো সম্ভব হতো না। তিনি মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়েছেন।
বাঙালি জাতির মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শুভ জন্মদিনে জানাই অবনতমস্তকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার বঙ্গমাতা মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ মত-দ্বিমত