কেন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো
৯ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৪৬
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার। একটি স্থলবেষ্টিত, দরিদ্র এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ এবং খনিজ সমৃদ্ধ একটি দেশ নাইজার। তবে পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগে রয়েছে দেশটি। পরিস্থিতি এমন যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হলেও আজও সম্পূর্ণভাবে এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি অনেক দেশ। এর পারিপার্শ্বিক কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। সম্প্রতি সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে এই দেশটিই আলোচনায় রয়েছে। যদিও এ ধরনের ঘটনা সেখানে এটাই প্রথম নয়। সাহারা মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত বিস্তীর্ণ দেশ নাইজার। ফ্রান্সের কাছ থকে ১৯৬০ সালে স্বাধীন হয় দেশটি। জেনারেল আবদুর রহমান চিয়ানি ২৬ জুলাই প্রেসিডেন্টকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করেন। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে নাইজারের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বুধবারের আগে, চারটি অভ্যুত্থান ও অসংখ্য অভ্যুত্থান-চেষ্টা হয়েছে।স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থানের কারণে দেশটির রাজনীতিতে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করেছিল। এখন আবার দেশটি অভ্যুত্থানের মুখোমুখি। খরাপ্রবণ দেশটি বর্তমানে সশস্ত্র জঙ্গিবাদ ও দারিদ্রে নিমজ্জিত। অর্থনীতিকে সচল রাখতে তেল ও স্বর্ণের খনি অনুসন্ধানে রয়েছে দেশটি। গত মাসের শেষের দিকে নাইজারের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডের প্রধান আবদোরাহমানে তিয়ানি। বাজোমা ২০২১ সালে নির্বাচনে জয় পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল তা। তিনি পশ্চিমাপন্থী হিসেবে পরিচিত। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় এ ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলো চুপ থাকবে না। এ অবস্থায় নাইজার পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসে দ্য ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস (ইকোওয়াস)।
বৈঠকে নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়। অভ্যুত্থানের পর পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশের বাণিজ্যিক সংগঠন ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস (ইকোয়াস) দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর অধীনে নাইজারের সাথে সব রকম বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ থাকবে। ওই অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেশটির যত সম্পদ আছে তা জব্দ করা হবে। তবে সামরিক হস্তক্ষেপ বিবেচনায়, নাইজার বর্তমান শাসক নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানা গেছে। পৃথিবী যখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে চাইছে তখন মিয়ানমার বা হালের নাইজারের মতো দেশে সামরিক শাসন চলছে। সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছে সেনাবাহিনী। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তু। গণতন্ত্রের অর্থাৎ জনগণের শাসনের দাবি থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র হুমকিতে থাকে। বন্দুকের নলের মুখে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। আফ্রিকা মহাদেশেই গত এক দশকে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি দেশে। ২০১২ সালে মালি এবং এরপর মিসর, বুরকিনা ফাসো,জিম্বাবুয়ে,সুদান,মালি,চাদ, গিনি এবং সর্বশেষ ফের সুদানেই সেনা অভুত্থান ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দা বা গণতন্ত্র ফেরতের দাবি থাকলেও সহসাই সে ধারা ফেরে না। ফলে বিশ্বজুড়েই গণতান্ত্রিক পরিবেশ অস্থিরতায় বিরাজ করে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো হলো- বেনিন, বুরকিনা ফাসো, কাবু ভের্দি,গাম্বিয়া, ঘানা,গিনি-বিসাউ, কোত দিভোয়ার, লাইবেরিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, সেন্ট হেলেনা দ্বীপ, সিয়েরা লিওন ও টোগো এই ১৮টি দেশ। একটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক ঐক্য না থাকা অথবা সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকা অর্থ হলো সেই দেশের নাগরিকের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধা, দেশ ত্যাগ অথবা সাময়িক কিছু সংকটের মুখোমুখি হওয়া। কারণ স্বাভাবিকভাবেই এ সময় নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে যা অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ বিষয় যদি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করে তখন সেদিকে নজর রাখতেই হয়। একদিকে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বিষয়টি ভালোচোখে না নেওয়া এবং অন্যদিকে নিজ দেশে জনগণের বেসামরকি ক্ষমতা হস্তান্তর করা এই দুই মিলে পরিস্থিতি যে খুব ভালো হবে না তা ভালোই টের পাচ্ছে অভ্যুত্থানকারী। বেশ চ্যালেঞ্জের মুখেই রয়েছে সেনাবাহিনী। বিবিসি’সর খবর থেকে জানা যায়, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসো, চাদ, গিনি, মালির পর এবার নাইজারের সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এসব দেশই কিন্তু ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ দেশ। বিবিসি’র ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে মোট ২৭ বার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, যার ৭৮ শতাংশই হয়েছে সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলিতে। তাছাড়া মালি, বুরকিনা ফাসো’র মতো কয়েকটি দেশে ফ্রান্সের বিরুদ্ধ মত বেশ জোরালো রয়েছে। এমনকি এখানেও অর্থাৎ নাইজারের ক্ষেত্রে এরকম দেখা গেছে। সেনাবাহিনী নাইজারের প্রেসিডেন্ট বাজউমকে উৎখাতের পর বলে যে, তিনি ছিলেন ফ্রান্সের বসানো পুতুল যার লক্ষ্য ছিল ফরাসি স্বার্থ রক্ষা করা। নাইজারে এখনও ফ্রান্সের সেনা রয়েছে। অর্থাৎ নাইজার স্বাধীন হলেও আজও ফ্রান্সের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। নাইজারের এই ঘটনার পর নাইজারে আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এবং সর্বশেষ উপায় হিসেবে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে সম্ভবত সেই পথে আগেই হাঁটবে না কোনো দেশ বা জোট। এর ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকা অস্থিতিশীল হতে পারে। কারণ বুরকিনা ফাসো এবং মালির সামরিক সরকার নাইজারে সামরিক সরকারের বিরোধীতা করেছে। নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে নাইজারে সামরিক কোনো ব্যবস্থা নিতে সবদিক ভাবা হবে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এমনিতেই পৃথিবীতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এরপর নতুন করে আর কোথাও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হোক বিশ্ব নেতারা এমনটা নিশ্চয়ই চাইবেন না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য কেন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো পশ্চিম আফ্রিকা কি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে মত-দ্বিমত