সর্বজনীন পেনশন স্কীম ও একজন নিভৃতচারী অর্থনীতিবিদের অবদান
২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৩৯
গত ১৭ই আগষ্ঠ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনের পরই সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পত্রিকায় এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। অনেকেই এর ভালো ও মন্দ দিকগুলো তুলে ধরছেন। তবে বেশিরভাগই এই কর্মসূচির ভূয়সী প্রশংসা করছেন। এ বিষয়ে কারো সন্দেহ ও দ্বিমত নেই যে, সর্বজনীন পেনশন স্কীমটির প্রবর্তন দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর জন্য শেষ জীবনে আর্থিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এই অতি জরুরি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিটি চালু করার পেছনে একজন অর্থনীতিবিদের অবদান অপরিসীম। এই মানব দরদী অর্থনীতিবিদ হলেন অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, যিনি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে বিদেশে সমধিক প্রসিদ্ধ।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি হিসাবে সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় তিনি বিষয়টি প্রায় প্রতি বছরই তুলে ধরেছেন। জোর তাগাদা দিয়েছেন এটি বাস্তবায়নের। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০ এর ৩২ পৃষ্টার সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীন ৭.৩৮ ক্রমিকে প্রস্তাব করা হয়েছে, “সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় “প্রবীণ নীড়” গড়ে তোলা সময়ের দাবি। দেশে একদিকে যেমন মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়ছে তেমনি বর্দ্ধিষ্ণু পরিবার (extended family) ভেঙ্গে অনু—পরিবার (nuclear family) বাড়ছে আর ফলশ্রম্নতিতে অনেক প্রবীণ মানুষদের বিশেষত দরিদ্র-নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রবীণদের আশ্রয়হীন হবার সম্ভাবনা বাড়ছে। আমরা মনে করি প্রবীণ মানুষদের জন্য “প্রবীণ নীড়” (“বৃদ্ধাশ্রম” নয়) গড়ে তোলার বিষয়টি বাজেটে থাকা জরুরি।”
বাজেট প্রস্তাবনার ৭.৪০ ক্রমিকে প্রস্তাব করা হয়েছে, “আমরা যেহেতু উন্নয়নে অগ্রগামী সেহেতু এখন থেকেই সার্বজনীন পেনশন প্রদানের বিষয় নিয়ে ভাবনা জরুরি। বিষয়টি আসন্ন বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য আমরা সুপারিশ করছি। একইভাবে, সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২০-২১’র ২০ নং ক্রমিকে উল্লেখ করা হয়েছে “সার্বজনীন পেনশন বিষয় নিয়ে এখনই ভাবনা জরুরি। বিষয়টি, আসন্ন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।” একইভাবে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় সর্বজনীন পেনশন স্কীমটি অতিদ্রুত চালুর জন্য প্রস্তাব করা হয়। আগ্রহী পাঠকগণ এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ওয়েবসাইটে আপলোডকৃত সমিতির প্রতি বছরের বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনাগুলো পড়ে দেখতে পারেন।
আমরা জানি ২০০৮ সালের সাধারণ নিবার্চনে জয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট সরকার গঠন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবার্চনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ ও ‘রূপকল্প ২০২১’ প্রণেতাদের অন্যতম একজন হলেন অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ওই নিবার্চনী ইশতেহারে দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে পরবতীর্তে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা উদ্যোগ কেউ নেয়নি। একমাত্র অধ্যাপক আবুল বারকাত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় প্রতি বছরই বিষয়টি জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন এবং এটি বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
এদেশে সম্ভবত অধ্যাপক আবুল বারকাতই একমাত্র অর্থনীতিবিদ যিনি “সার্বজনীন পেনশন” বিষয়টির ধারণাত্মক কাঠামো বিনির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি একই সাথে জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্তের জন্য সার্বজনীন পেনশনের আর্থিক হিসেবপত্তরও করে দেখিয়েছেন যে আগামী ৫ অর্থবছরে-২০২৩/২৪ থেকে ২০২৭/২৮-মোট ৩ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। এসবের পাশাপাশি তিনি এও দেখিয়েছেন যে সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচী বাস্তবায়নে অর্থের উৎস হিসেবে কালোটাকা ও অর্থপাচার উদ্ধার থেকে শুরু করে সম্পদ কর ও অতিরিক্ত মুনাফার উপর কর নিয়ে ভাবা যেতে পারে (যা নিয়ে ভাবা হয় না)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’র প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনশুমারি বলছে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। অন্যদিকে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে ওই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে নির্ভরশীল মানুষের বর্তমান হার ৭.৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৫৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারি চাকরি করছেন মাত্র ১৪ লাখ মানুষ। এসব সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পেনশন সুবিধা রয়েছে। বাকি ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি, বেসরকারি খাত, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। এদের কোনও পেনশন সুবিধা নেই। এই বিপুল সংখ্যাক মানুষকে পেনশনের আওতায় আনতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত। এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সবার্ঙ্গীন কল্যাণের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কীম যে কার্যকর ভূমিকা রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন চালুর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বিশ্বে বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদা দেবে। এই উদ্যোগ তাঁর দূরদর্শী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম হাতিয়ার। বর্তমান শ্রমশক্তিকে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। এই উদ্যোগ কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেটে প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর দাবীর যৌক্তিকতা মেনে নিয়েই বর্তমান সরকার এই কর্মসূচিটি চালু করল। এ বিষয়ে ২০২২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি জাগোনিউজ২৪.কম এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশ নেয়। ওই আলোচনায় প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ প্রবর্তন করার প্রস্তাব দিয়েছিল।”
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। যুগান্তকারী এ উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানায়।” উক্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, “‘প্রবীণ হিতৈষী বিভাগ’ নামে নতুন একটি খাত সংযুক্ত করে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সেই ধারাবাহিকতায় সব নাগরিকের জন্য পেনশন সুবিধা চালু করায় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।”
আরও উল্লেখ করা হয়, “আজকের প্রবীণ মানুষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা। আমাদের সব অর্জনেই তাদের অবদান রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ‘প্রবীণ নীড়’ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। দেশে একদিকে যেমন মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়ছে, তেমনি পুঁজিবাদের ধাক্কায় বর্ধিষ্ণু পরিবার ভেঙে অণুপরিবার বাড়ছে। সেই সঙ্গে কভিড-১৯ মহাবিপর্যয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি পর্যুদস্ত হচ্ছে প্রবীণ মানুষের জীবন। এতে করে অনেক প্রবীণ মানুষ, বিশেষত দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রবীণদের আশ্রয়হীন হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়ছে। এসব যৌক্তিক কারণেই প্রবীণ মানুষদের জন্য ‘প্রবীণ নীড়’ (বৃদ্ধাশ্রম নয়) গড়ে তোলা জরুরি। বিষয়টি বাজেটে অগ্রাধিকারযোগ্য।”
পরিশেষে, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করায় কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেই সাথে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও সমিতির সভাপতি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত’র প্রতি। দেশ ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে তিনি ইতিপূর্বে যত মৌলিক গবেষণা করেছেন তার প্রত্যেকটিরই বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখেছি।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা ও মৌলিক গবেষণায় অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত অব্যাহতভাবে যে অবদান রেখে যাচ্ছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যন্ত তিনি যত গবেষণাকর্ম করেছেন সেসবের কয়েকটি মাইলফলক বা দিকনির্দেশক হিসেবে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়েছে তেমনি এদেশের উন্নয়ন-নীতি, কর্মসূচি প্রণয়নে ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মানব দরদী, দেশপ্রেমী ও সুগভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এই অর্থনীতিবিদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞ।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মতিউর রহমান মত-দ্বিমত সর্বজনীন পেনশন স্কীম ও একজন নিভৃতচারী অর্থনীতিবিদের অবদান