Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিচার প্রক্রিয়া নিজস্ব গতিতে চলবে, বিবৃতির গতিতে নয়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:১৮

বাংলাদেশে কেউই যে আইনের উর্ধ্বে নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সেই সমতার প্রেক্ষাপটেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ কোনোরকম আইনের ব্যত্যয় দৃষ্টান্ততো নয়ই বরঞ্চ আইনের শাসনকেই আরও সমৃদ্ধ করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল জয় আমাদের জন্য যেমন গর্বের ঠিক তেমনি তার কোনো কর্মকাণ্ড যদি এদেশের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে, সাধারণ মানুষকে কষ্টের সম্মুখীন করে থাকে তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। ইউনূসের বিরুদ্ধে যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলমান তা শ্রম আইনের ধারায় করা। শ্রম আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে ব্যবসায়িক লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিককল্যাণ তহবিলে প্রদান করতে। এখানে ইউনূসের বিরুদ্ধে যারা মামলা করছেন তারা তার প্রতিষ্ঠানেরই সংক্ষুব্ধ কর্মচারী। কখনো বলতে শোনা যায়, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৫০-২০০ মামলা করা হয়েছে। মূলত ১৫০ জন ভুক্তভোগী একই ধারায় মামলাটি করেছেন, যার শুনানিও একটিই।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর ১৬০ জনের বেশি বিশ্বনেতার খোলা চিঠি কিছুটা সন্দেহের উদ্রেক করে। কেননা পৃথিবীর কোনো সংকটেও এতজন নোবেল লরিয়েটের একত্রে বিবৃতি প্রদানের নজির আর দ্বিতীয়টি নেই। সন্দহের কারণ এখানেই, যদিও বিবৃতি দেওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। আইনের চলমান প্রক্রিয়া যদি বিবৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, তাহলে হয়তো আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে পেতাম না, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পক্ষেও বিভিন্ন বিবৃতি দেখা গিয়েছে।

বিশ্বনেতাদের আহ্বানকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান যে বিচার প্রক্রিয়া তাতে আইনের কোনো ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছেনা, বরঞ্চ মামলার ক্ষেত্রে আসামীর যে হাজিরা প্রক্রিয়া সেখান থেকেও ড. ইউনুসকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার সামাজিক অবস্থান, বয়স সব বিচার বিবেচনায় তাকে সর্বাধিক সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। শ্রম আদালতে বিচারাধীন বর্তমান বিচারিক মামলার অভিযোগকারীরা গ্রামীণ টেলিকমের কর্মী। এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। শ্রমিকরাই মামলা করেছে এবং এই মামলা নিয়ে তারা কী করতে চায়, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তাদের। দ্বিতীয় শ্রম মামলাটি শ্রম আইন লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য শ্রম বিভাগ থেকে করা হয়। অভিযোগগুলো সঠিক নয় এমন কোনো প্রমাণ প্রফেসর ইউনূসের পক্ষ থেকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। যা দাবি করা হয়েছে তা হলো ‘ব্যতিক্রমবাদ’। ব্যতিক্রম ঘটনা থেকেই একটি আইনের শাসনের দিকে এগিয়ে যায়। এদেশে কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার নজির ছিলোনা, তার মানে কি শুরু করারও সুযোগ নেই। শ্রমআইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার নজির কম থাকলেও এই প্রক্রিয়াকে শুরু করাকে সাধুবাদ জানাই।

বাংলাদেশের শ্রমঅধিকার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব প্রায়ই বিভিন্ন কথা বলে, অভিযোগ করে থাকে, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা স্থগিত করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা জিএসপি প্লাস সুবিধা অর্জনেরও পূর্বশর্ত। সেই পশ্চিমা বিশ্বেরই প্রথিতযশা ব্যক্তিগণ যখন শ্রম আইনের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপকে স্থগিতের আহ্বান জানান তখন আর বলার কিছু থাকেনা। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই বাংলাদেশের আইনে বিচারকদের একটি প্যানেল গঠন করে তা পরিবর্তন-পর্যালোচনা করার ক্ষমতা কোনো কর্তৃপক্ষের নেই। শ্রম আদালতে একজন বিচারক সভাপতিত্ব করেন। প্রফেসর ইউনূস শ্রম আদালতের বিচারকদের একটি প্যানেলের সামনে রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করার সুযোগ পাবেন। তারপরে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের শরণাপন্ন হবেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এফআইআর অনুযায়ী, আইন অনুমোদিত সংস্থার তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারকে অভিযোগ পর্যালোচনা করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিচারকদের একটি প্যানেল গঠন করার অনুমতি দেয়ার কোনো আইন নেই।

যে কোনো কর্তৃপক্ষের যেকোনো অভিযোগ পর্যালোচনার জন্য মূলত আইন লঙ্ঘন অভিযোগের তদন্তের প্রয়োজন হয়। দুদক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঠিক সেটাই করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই বিবৃতিদাতাদের আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়ায় আইনের কোনো ব্যতয় আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য। একই আহ্বান আমারও থাকবে। যেখানে আইবের কোনো ব্যত্যয় বা দ্রুত শাস্তি দেওয়ার কোনো বিষয়ই দেখা যাচ্ছেনা সেখানে তাদের এরূপ বিবৃতিতে বোঝা যায়, তাদের তথ্যের যথেষ্ট অভাব ও বিভ্রাট রয়েছে অথবা তাদের ভুল বোঝানোও হতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার উঠে পড়ে লেগেছে এরূপ চটকদার কথায় তাদের ভুলানোর চেষ্টা হতে পারে। সরকার যদি উঠে পড়েই লাগতো তাহলে ড. ইউনুস তার সব কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনা করছেন কিভাবে। যেখানে ইউনূসের বিরুদ্ধে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বন্ধের ক্ষেত্রে তদবির করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে সেখানে ড. ইউনুস নির্ভার ভাবেই সব কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছেন। বিপরীত দেখা যাচ্ছে ড. ইউনূসকে নিয়ে বিরোধী দলগুলোর এক রকম আস্ফালন, তাদের বৈদেশিক নালিশের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছেন এখন তিনি।

আন্দোলনে সুবিধা করতে না পেরে তারা এখন চাচ্ছে ড. ইউনূসের বৈদেশিক যোগাযোগের উপর সওয়ার হয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে। তারা যদি সত্যি এহেন কার্যক্রমে লিপ্ত থাকে তাহলে আরেকবার প্রমাণিত হবে তারা এদেশের জনগণের উপর কোনোরূপ আস্থা রাখেনা, তাদের সব আস্থা বৈদেশিক শক্তিগুলোর উপরে। এদেশের জনগণযে তাদের চায়না তা আন্দোলনে নামার পর তাদের কাছে আরও সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।সর্বোপরি বলতে চাই, আইন চলবে তার নিজস্ব গতিতে, বিবৃতির গতিতে নয়। মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের জয় এদেশের শ্রমঅধিকারকে সমৃদ্ধ করবে, সেই সাথে ড. ইউনুস ন্যায্য বিচার পাবেন এটাও আশা করছি। এদেশের বিচার প্রক্রিয়া যে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও সমতার ভিত্তিতে চলছে তা আরও একবার প্রমাণিত হোক। বিদেশী বন্ধুদের আমি আহ্বান জানাবো তারা এই বিচার প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে। নোবেল বিজয় কাউকে আইনের উর্ধ্বে নিয়ে যায়না। অতীতে বহু নোবেল বিজয়ীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার নজির রয়েছে।

লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এজেডএস

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বিচার প্রক্রিয়া চলবে তার নিজস্ব গতিতে বিবৃতির গতিতে নয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর