জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্জন
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৫৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন প্রশ্ন হল- এই সম্মেলনে বাংলাদেশের কী অর্জন হল? উত্তরে বলতেই হয় বাংলাদেশের অর্জন বিপুল। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন একদম দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। এই সময়ে দেশে যখন কুটনৈতিক পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ঠিক তখন সারা পৃথিবীর সব বাঘাবাঘা বিশ্বনেতার সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হাজির হওয়টা এক বিরাট অর্জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমদিনে দুটি অধিবেশনে বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাংলাদেশকে গ্লোবাল সাউথের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে বিশ্বের সংহতি শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর আওতায় বিশ্ব অর্থনীতির ৮৫ শতাংশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ ঘটে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনগণও বসবাস করে এসব দেশে। এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরো ১৯টি দেশ। এসব দেশ হচ্ছে – আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। স্পেন সব সময়ই অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে আমন্ত্রণ পায়।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু যে ভারত এটি আর একবার প্রমাণিত হল। বাংলাদেশ জি-২০ সদস্য না হয়েও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত বিরল সম্মানে ভূষিত করেছে। ভারতের সভাপতিত্বে এবারের জি-২০ সামিটে বাংলাদেশসহ মোট নয়টি দেশকে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অন্য দেশগুলো হলো মিশর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন এবং আরব আমিরাত। এর মধ্যে জি-২০ সংক্রান্ত সব সভাতেই বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে। আর নয়াদিল্লিতে এই অনুষ্ঠানে যোগদানকারী বিশ্ব নেতারা হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়ল, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা টিনুবু, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা প্রমুখ।
‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যত’ শীর্ষ সম্মেলনের এই মূল প্রতিপাদ্যের অধীনে শেখ হাসিনার এই সম্মেলনে যোগদানের সবচেয়ে বড় অর্জন অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে নির্বাচনের আগে সর্বশেষ দীর্ঘ বৈঠক। শুক্রবার ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর বাসভবনে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা ধরে চলেছে ওই বৈঠক। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এক পর্যায়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত আলোচনাও হয়েছে। বৈঠকের ঠিক পর পরই প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজের এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্টে বাংলায় লেখেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। ” জানা গেছে বৈঠকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অনুরোধ রাখতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়েও বৈঠকে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া কৃষি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদানপ্রদানের লক্ষ্যে এবং রুপি ও টাকায় বাণিজ্যিক লেনদেনের পথ প্রশস্ত করতে বৈঠকে তিনটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থনকে যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে খুব জোরালো একটা ফ্যাক্টর বলে মনে করা হয়,তাই বাংলাদেশের নির্বাচনের ঠিক আগে দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে এই বৈঠকের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্যও ছিল অপরিসীম। এই পটভূমিতে ভারত বৈঠকে আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভারতের দৃঢ় সমর্থন ও সাহায্যের অঙ্গীকার অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে বলে জানা গেছে।
এর বাহিরে এই সম্মেলনে দুই অধিবেশনে বিশ্বদরবারে নিজেকে উজাড় করে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাথে সেলফি তোলা কিংবা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কথা বলার ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় দৃষ্টি কেড়েছে সকলের। শুধু নেট দুনিয়ায় নয়;ছবিগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্থান পেয়েছে। বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকের পরদিন জি-২০ সম্মেলনস্থলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। এ সময় তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হয়। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বাইডেন তখনই মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে সেলফিও তোলেন। একই দিন রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতির দেওয়া নৈশভোজেও জো বাইডেনের সঙ্গে আলাপ হয় শেখ হাসিনার। ছবিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে শেখ হাসিনা ও বাইডেনের মাঝখানে দেখা যায়। নৈশভোজের আলাপে মোদির উপস্থিতি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। শেখ রেহানাকে এ সময় বাইডেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের মধ্যে বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দুই দফার কুশল বিনিময়ের যে চিত্র দেখা গেল, তাতে অনেকের ধারণা যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশের ব্যাপারে আগের অবস্থান থেকে সরে আসবে। নৈশভোজের ফাঁকে পশ্চিমপঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কুশল বিনিময় হয় প্রধানমন্ত্রীর। রবিবার সকালে নাশতার টেবিলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গেও আলাপ হয় শেখ হাসিনার।
শনিবার নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনের মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে জৈব জ্বালানির বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স (জিবিএ)। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নেতৃত্বাধীন এই জোটের সদস্য হলো বাংলাদেশও। ভারতের প্রস্তাবে এই জোটের সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোনো জোটের সদস্য হলো বাংলাদেশ। এর ফলে জিবিএ জোটের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি-২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহামেদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান,সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়েওল, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজের সাথে সাইডলাইনে বৈঠক করেন। জি-২০ সম্মেলনের রেশ কাটতে না কাটতেই সম্মেলন থেকেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। বলা যায় এক ছাদের নিচে বিশ্বের সব বাঘাবাঘা নেতাকে পাওয়া গেল। যা নিকট অতীতে বাংলাদেশের জন্য বিরল ঘটনা। এতগুলো নেতার সাথে দেখা করতে হলে বাংলাদেশের বহু সময় অপেক্ষা করতে হত।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য জি-২০ সম্মেলন ছিল এক সুখকর অভিজ্ঞতা। আবরও বলতে হয়- এই অভিজ্ঞতাকে বাস্তবে রূপদান করেছে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশেরই অকৃত্রিম বন্ধু এই সম্মেলনের আয়োজক দেশ ভারত। ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পাশে ছিল ঠিক একইভাবে এখনও আছে। এজন্য ভারতকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। দেশ বা প্রতিষ্ঠান চালায় কিছু মানুষ। সেই মানুষগুলির কারণে পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে ওঠে। এই সম্মেলনের মধ্য মনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর পুরো আয়োজনটি পিছন থেকে সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন একসময়ে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় হাইকমিশনার, ভারতের সাবেক বিদেশ সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। শ্রিংলার পরামর্শেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরল সম্মানে ভূষিত করে এবং বিশ্বনেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দেয়। ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি এবং শ্রিংলাও বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। তাদের দেওয়া এ সম্মান এবং সুযোগ নিশ্চই বাংলাদেশের জনগণ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবে।
লেখক: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
সারাবাংলা/এসবিডিই