আন্দোলন, নাকি নির্বাচন?
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৫৪
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে, তখন বিএনপি একদফা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতি অর্থাৎ সরকার পতনের আশা নিয়ে মাঠে আছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনও একটি সুষ্ঠু, বিতর্কমুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে। কোনটি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে – আন্দোলন, নাকি নির্বাচন? আন্দোলন কতটুকু জমবে, তাতে সরকারের পতন হবে কিনা তা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় থাকলেও নির্বাচন হওয়া নিয়ে বোধহয় তেমন সংশয় নেই। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তৃণমূল বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির দুই সাবেক নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে বসেছেন। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মামুন জানিয়েছেন, বিএনপি থেকে আরও অনেকেই তৃণমূল বিএনপিতে চলে আসবে।
বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার কোনো উদ্যোগ কোনোভাবে কেউ করছে বলে জানা যায় না। তবে আগামী নির্বাচন কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ, সাবেক সচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূত, সম্পাদক, সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা। তাঁরা নির্বাচন নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশার পাশাপাশি নানা আশঙ্কা, বর্তমান পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সমঝোতার মতো বিষয়ে মতামত দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দলীয়করণের ফলে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় প্রশাসন ও পুলিশ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলে বিশিষ্টজনদের অনেকেই মনে করেন। তাঁরা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আস্থার সংকট ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
বিশিষ্টজনদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘নির্বাচন আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। আমরা একটা কঠিন অবস্থায় আছি। সংকট আছে, আপনারা বলেছেন, আমরাও অনুধাবন করি। সেই সংকট নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে।’ তাঁর মতে, নির্বাচনটা ভালো হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। বারবার বলেছি, আমাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ রাজনীতিবিদেরা যদি তৈরি করে না দেন, তাহলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করাটা কষ্টসাধ্য হবে।’
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, রাজনৈতিক বিপরীতধর্মী মতকে কাছাকাছি আনার কোনো উদ্যোগ নেই। দলগুলোর মধ্যে নেই, নাগরিক সমাজের মধ্যেও নেই।
বড় দুই দলের সমঝোতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক মাহবুব কামাল। তিনি বলেছেন, সমঝোতা ছাড়া যত আলোচনাই হোক, তা ফলপ্রসূ হবে না। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার প্রসঙ্গ টেনে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, একটা সমঝোতার কথা। আপনারা চায়ের টেবিলে বসেন। কিন্তু পলিটিক্যাল কালচার এমন হয়েছে যে, কেউ কারও সঙ্গে বসতে চাচ্ছেন না।‘
তারপরও বর্তমান সরকারের প্রতি নিজের আস্থার কথা জানিয়ে সিইসি বলেছেন, ‘সরকারের তরফ থেকে ইদানীং বারবার বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনকে তাঁরা সুষ্ঠু করতে চান। প্রধানমন্ত্রীও স্পষ্টভাবে কয়েকবার বলেছেন, সরকার আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আমি আস্থা রাখতে চাই।’
ইসি আস্থা রাখলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। যার যার অবস্থানে থেকে এখন চলছে প্রস্তুতি। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে ধরে নিয়েই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পরবর্তী কয়েক মাসের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিদেশি কয়েকটি রাষ্ট্রের আগ্রহ, তৎপরতা, পরামর্শ পুরো বিষয়টিতে এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। এই অবস্থায় নির্বাচনের আগে শেষ বিদেশ সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নেয়াসহ ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। যোগ দেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেয়া নৈশভোজেও।
আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনের মূলপর্ব শুরু হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘বিশ্বাস পুনর্গঠন ও বিশ্ব সংহতির পুনরুদ্ধার: ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে ত্বরান্বিত পদক্ষেপ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং সবার জন্য স্থায়িত্বের দিকে।’
জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেছেন। সদস্য না হয়েও ব্রিকস সম্মেলন, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চমক জাগানিয়া’ কূটনীতি উপহার দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে দেশে বিদেশে অনেকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। মনে করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্য বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতিসংঘে কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল। বিশ্বের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী গত দুমাসে বৈঠক সেরে ফেলেছেন। ব্রিকসে চীনের প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। এর আগে জাপান সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ঢাকায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘে দ্বিপক্ষীয় কোনো বৈঠক না হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেয়া অভ্যর্থনার সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার দেখা হতে পারে। এসব অল্প সময়ের দেখাসাক্ষাৎও একেবারে তাৎপর্যহীন নয়। একটি সামান্য ছবিও ক্ষেত্রবিশেষে অসাধারণ গুরুত্ববহ হতে পারে।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে অনুষ্ঠিত না হওয়ার কোনো কারণ এখনো ঘটেনি। বিএনপির দাবি মেনে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন সরকার হওয়ারও বাস্তব অবস্থা এখনো দেশে নেই। বরং ভোটের প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজপথে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় প্রস্তুতিও রয়েছে সরকার ও সরকারি দলের। বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলোর আন্দোলন মোকাবিলা করার পাশাপাশি ভোটের প্রস্তুতি নিতে দলের নেতাকর্মীরা কাজ শুরু করেছে। আন্দোলন করলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে বলেও আশা প্রকাশ করছেন তারা।
স্থানীয় সরকার দিবস উপলক্ষে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের মিলনমেলায় নির্বাচন পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার অঙ্গীকারও করেন তারা। নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নিজ এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বিএনপি ও জামায়াতের যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রুখে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। ওই অনুষ্ঠানে দেশের মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অন্য দিকে, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আন্দোলনের মাধ্যমেই জয়ের আশা করছে। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তারা এক দফা আন্দোলনের পরিণতি দেখতে চান। তারা মনে করেন, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন ঠেকানো কঠিন হবে। এজন্য যুগপৎ আন্দোলনকে অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত রূপ দিতে ২০ দিনের সময়সীমা বেঁধে অলআউট কর্মসূচির রোডম্যাপ ঠিক করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। বিএনপি নেতাদের বরাত দিয়ে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, এবারের আন্দোলনে ‘সময়সীমা’ থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে মামলা-হামলার মধ্যেও আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তরুণ নেতৃত্বকে সামনে রেখে চলমান কর্মসূচি ধাপে ধাপে টেনে নির্বাচন পর্যন্ত নেয়া হবে।
জানা গেছে, এক দফা কর্মসূচির চূড়ান্ত সময়সীমা চলতি সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসকে ধরে আন্দোলনের রোডম্যাপ তৈরি করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দফায় দফায় স্থায়ী কমিটির বৈঠক করেও নেতাদের মতপার্থক্যের কারণে কর্মসূচির ধরন ও সময়সীমা চূড়ান্ত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে দলটিকে। দলের ভেতরে কেউ কেউ জামায়তকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কেউ মনে করছেন, আর বিলম্ব নয়- এই মুহূর্তে হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি না দিলে সরকার পতন সম্ভব হবে না। তবে সবদিক ভেবে আপাতত জামায়াতকে ছাড়াই অহিংস কর্মসূচির পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, সরকারকে ‘বড় ধরনের ঝাঁকুনি’ দেয়ার সময় এসেছে। এবার গতানুগতিক কর্মসূচি নয়; ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর- এই সময়টাকে ‘মোক্ষম ক্ষণ’ ধরে সরকার পতনের লাগাতার অলআউট কর্মসূচি দেয়া হবে। এক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের প্রথম ভাগে ছিল- গণমিছিল, পদযাত্রা ও সমাবেশের কর্মসূচি। দলের তিন অঙ্গসহযোগী সংগঠনের চলমান লং মার্চ শেষ হলেই ফের ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হবে।
দ্বিতীয় ভাগে মহাসমাবেশ, সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে অবস্থান ও অবরোধ কর্মসূচি দেয়ার চিন্তা করা হয়েছে। এসব কর্মসূচি চলবে একটানা অক্টোবরের মধ্যভাগ পর্যন্ত। এর ফাঁকে দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বিরোধী দলগুলোসহ সব মহলের নজরে আনতে আদালত ঘেরাও, আদালতের সামনে বিক্ষোভ, পুলিশ সদর দপ্তর, ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে। ধাপে ধাপে এসব টানা কর্মসূচি চলাকালে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আন্দোলনের ধরন ও সময় পরিবর্তন হতে পারে। আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপির নেতাদের প্রত্যাশা- মাঠের আন্দোলনে যে কোনো একটি ছোট্ট ইস্যুতেও এমন ‘মোক্ষম ক্ষণ’ চলে আসতে পারে। যে সূত্র ধরেই দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটবে।
তবে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অতীতে কখনো সাফল্য পায়নি বিএনপি। এবারেও তাদের আশা আশঙ্কায় পরিণত হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই