দলিল যার, জমি তার; ৬০ বিঘার বেশি নয় উত্তরাধিকার
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৬
দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ভূমি সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্দেশ্যে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইনের (বাংলাদেশ গেজেট, সোমবার ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) পিডিএফ কপি পড়ছিলাম অনলাইনে। কারণ আমার পেশার আরেকটি অংশ হচ্ছে শিক্ষকতা, পরবর্তী ক্লাসে স্টুডেন্টদের এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা দিতে হবে।
পড়তে পড়তে মনে হলো বিবিসি ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি সায়েদুল ইসলামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেছেন, “বিচারাধীন মামলার ৬০ শতাংশের বেশিই জমিজমা সংক্রান্ত। অধিকাংশ মামলার ‘রুট’ হচ্ছে জমি নিয়ে।” এসব অপরাধের অনেকগুলো দেওয়ানি অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলোর বিচার হতেও অনেক সময় লাগে। নতুন যে আইন পাশ হলো ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তার অনেকগুলোই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে দ্রুত বিচারের আওতায় আসবে।
নতুন যে আইন পাশ হলো এর মূল লক্ষ্য কী?
নতুন আইনে ভূমির জবরদখল,ক্ষতি,জাল কাগজপত্র তৈরী করে জালিয়াতি বা প্রতারণা বন্ধ করার বিধান বাতলে দেয়া হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস করে জনগণের ভোগান্তি দূর করার কথা বলা হয়েছে,ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধ করা ও অপরাধ সংঘটিত হলে তা দ্রুত আইনের আলোকে প্রতিকার করার দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ভূমি আইন মোতাবেক প্রতারণা ও জালিয়াতি করলে সর্বোচ্চ সাজা ৭বছর। এ অপরাধ ফৌজদারি হিসেবে গণ্য হবে। ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে।
অন্যের জমি নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে অন্যের কাছে বেচে দিলে ৭ বছরের জেল হবে এবং এ সাজা অজামিনযোগ্য। ৪ (ভূমি প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড) ও ৫ (ভূমি জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড) ধারার অপরাধ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও বিভাগীয় কমিশনার নিষ্পত্তি করবেন। এছাড়া অন্যান্য অপরাশ ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট বিচার করবেন। সাজা সর্বোচ্চ ২ বছর।
নতুন আইনে উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছে কোন ব্যক্তি ৬০ বিঘার বেশি জমি ব্যক্তি মালিকানায় রাখতে পারবেন না। উত্তরাধিকারসূত্রে যাদের এর চেয়েও বেশি আছে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার বাকি জমি নিয়ে নিবে।
সরকারী বেদখলকৃত জমি, সরকার যখন প্রয়োজন মনে করবে তখনই দখল মুক্ত করতে পারবে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ভূমি আইন অনেক পুরোনো। ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (The State Acquisition and Tenancy Act) পাশের মাধ্যমে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির পর ভূমি রাজস্ব ও ভূমি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার রাজস্ব বিভাগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তিত হয় ও এর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে তিনটি ভিন্ন মন্ত্রণালয় যথা ভূমি মন্ত্রণালয়,আইন-বিচার-সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। Record of Rights (RoR) জমির যে রেকর্ড তা হচ্ছে ভূমির পরবর্তী সব ধাপ নির্ধারণে সহায়তা করে। The Survey Act 1875 এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুযায়ী সরকারের জরিপ বিভাগ সরেজমিনে জরিপ করে ভূমির মালিকানার যে বিবরণ এবং নকশা তৈরী করে তাই রেকর্ড বা জরিপ এবং নকশার সমন্বয়। 1888 সালের Cadastral Survey (CS), 1950 সালের State Acquisition Survey (SA), পরবর্তীকালের Revisional Survey(RS),1956-1962 পর্যন্ত Pakistan Survey (PS) এবং 1998-99 থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলমান জরিপকে Bangladesh Survey (BS) জরিপ বলা হয়-মহানগরে যা সিটি জরিপ নামে আখ্যায়িত।
২০২৩ সালের ভূমি অপরাধ হ্রাসে যে আইন প্রণীত হলো তা কার্যকর হলে নিঃসন্দেহে যেসব কর্মকান্ডের হার কমে আসবে তার তালিকা এমন
১. জাল দলিল তৈরি
২. মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদন
৩. একই জমি একাধিকবার বিক্রয়
৪. বায়নাকৃত জমির পুনরায় চুক্তি করা
৫. ভুল বুঝিয়ে দানপত্র
৬. সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের নামে দলিল
৭. সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি
৮. অবৈধ দখল
৯. সহ-উত্তরাধিকারীর জমি দখল করে রাখা
১০. অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালি উত্তোলন
১১. জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করার শাস্তি
১২. বিনা অনুমতিতে জমির উপরের স্তর কেটে নেয়া
১৩. অধিগ্রহণের পূর্বে অতিরিক্ত মূল্যে জমির দলিল
১৪. জনসাধারণের ব্যবহার্য বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল
১৫. বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি
১৬. রিয়েল এস্টেট কর্তৃক জমি বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর সংক্রান্ত অপরাধ
১৭. চুক্তির পর ভূমি মালিককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেয়া
১৮. সরকারি-বেসরকারি বা সংস্থার জমির বেআইনি দখল
১৯. নদী, হাওর, বিল বা জলাভূমির ক্ষতি
২০. অবৈধ দখল গ্রহণ ও বজায় রাখতে পেশিশক্তি
২১. পুনরায় অপরাধ করা
২২. বেশি জমি লিখিয়ে নেয়া
২৩. প্রতিবেশী ভূমি মালিকের ক্ষতিসাধন
২৪. অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচনা
উপরেল্লোখিত অপরাধগুলোর বিভিন্ন মেয়াদের বিবিধ সাজার বিধান এই আইনে রাখা হয়েছে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধগুলোর মূল কারণ কী? দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় মামলার বেলাতেই দেখা যায় জমিজমার ভাগ বাটোয়ারা,কার কতটুকু অংশ এ নিয়ে পারিবারিক যে দ্বন্দ্ব তার সূত্র ধরে নানা ধরনের ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটে এবং পরবর্তীতে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে মামলা মোকদ্দমা।
এ নিয়ে বিবিসির সায়েদা আক্তার যে প্রতিবেদন তৈরী করেন ২০২২ সালে সেখানে তিনি এটর্নি জেনারেলের সাথে আলাপের সারবত্তা হিসেবে ৬টি কারণ উল্লেখ করেন জমিজমা নিয়ে মামলার মূল বিরোধের ভিত্তি হিসেবে, সেগুলো হলো
১. পারিবারিক বিরোধ
২. জমির স্বল্পতা ও চাহিদা বৃদ্ধি
৩. সীমানা নির্ধারণ
৪. জমি দখল
৫. ভূমি জরিপ বা রেকর্ডে তথ্য বিভ্রাট
৬. সচেতনতার অভাব
ভূমি জরিপ বা রেকর্ডের তথ্য বিভ্রাটের সূত্র ধরেই মাননীয় ভূমিমন্ত্রী সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ডিজিটাল সার্ভে করার উপর জোর দান করেছেন,সেইসাথে আগে যে বদ্ধমূল ধারণা ছিল দখল যার,জমি তার-এর বিপরীতে দলিল যার,জমি তার স্লোগান জনপ্রিয় করার বিষয়ে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন।
ইতিমধ্যে পটুয়াখালী ও বরগুনায় পাইলটিং প্রকল্প চলছে ডিজিটাল সার্ভেএ কার্যকারীতা দেখার জন্য। ডিজিটাল সার্ভে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা গেলে পূর্বের সব সার্ভে বাতিল হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের সীমানার প্রতি ইঞ্চি মাটি একটি তথ্য বাতায়নের অন্তর্ভুক্ত হবে।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা গায়ের জোরে দুর্বলকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে কাঠামোগত প্রক্রিয়া সেখানে একটি দাঁড়ি ফেলার কাজ করবে যদি প্রকৃত দলিলের মাধ্যমে প্রকৃত মালিকানা জমির নির্ধারণ হয় এবং প্রকৃত মালিককে তার দখল বুঝিয়ে দিতে প্রতি এলাকার আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটায়,বঞ্চিতকে তার অধিকার ফিরে পেতে সহায়তা করে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে।
অন্যদিকে ভূমি সংশ্লিষ্ট অপরাধকে লাগাম দিতে পারবে ডিজিটাল সার্ভে-ডিজিটাল সার্ভের জন্য ব্যক্তির আইডেন্টিফিকেশনের কাজটি হওয়া দরকার নির্ভুলভাবে।
অনেক না হওয়ার মধ্যেও হচ্ছে আবার অনেক কিছুই। সেই হওয়াটাকে টেকসই ও মজবুত করতে সকলের সচেতনতা,আগ্রহ ও প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
https://www.bbc.com/bengali/news-60107916
https://www.bbc.com/bengali/news-60107720
https://www.prothomalo.com/bangladesh/2r01rfpwx8
https://www.somoynews.tv/news/2023-09-13/CU6QG2V3
https://minland.gov.bd/site/page/4ca51cdb-3bdb-477c-95ef-99b743f8ab2d//%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%9F
https://minland.gov.bd/site/page/6d032730-5948-4022-91a4-da20d2caa520/Bangladesh-Land-Survey-(CS,-RS,-SA,-PS,-BS)-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AA-%E0%A6%95%E0%A6%BF
ডিজিটাল ছাড়া আগের পদ্ধতিতে হওয়া সব ভূমি জরিপ বাতিল (ittefaq.com.bd)
https://www.dpp.gov.bd/upload_file/gazettes/50349_92148.pdf
https://www.dpp.gov.bd/upload_file/gazettes/50350_70207.pdf
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অর্পিতা চৌধুরী দলিল যার জমি তার; ৬০ বিঘার বেশি নয় উত্তরাধিকার মত-দ্বিমত