জাতিসংঘে শেখ হাসিনার বিশ্বরেকর্ড
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৩
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসামান্য কূটনৈতিক দক্ষতায় ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের দুইটি শক্তিশালী রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধী করেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তি বাংলাদেশের বিশাল অর্জন ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব গুনের কারণে যা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল। জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তির এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘের সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বারের মতো জাতিসংঘের ৫১ তম অধিবেশনে ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রথম ভাষণে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে বলেছিলেন,‘আজ থেকে ২২ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক মহান ভাষণ দিয়েছিলেন।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে,জাতির জনকের কন্যা হিসেবে এই অনন্য বিশ্ব ফোরামে বক্তব্য রাখার বিরল সম্মান ও সুযোগ আমাকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে।এর মধ্যে বিশ্বে অনেক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে,পুরনো আদর্শ ভিত্তিক বিভক্তি ভেঙে পড়েছে,আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিগত দুই দশকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে নতুন শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক জোটের উদ্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ সেপ্টেম্বর ৭৮ তম অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন।প্রতিবারের সাধারণ অধিবেশনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাহসী উচ্চারণ করেন।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আজ আপনাদের সকলের কাছে,বিশ্ব নেতাদের কাছে আমার আবেদন যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি,মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করুন।’গনতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন,‘একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারবদ্ধ।আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করতে চাই যে,বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র,আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে দেয়া বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন।জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক কালে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে,তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ন্যায় সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আরও তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে আমাদের মধ্যে মানবিক ঐক্যবদ্ধ-ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ।পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতিই কেবল বর্তমান সমস্যার যুক্তিসংগত সমাধান ঘটাতে সক্ষম।বর্তমান দুর্যোগ কাটাতে হলে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার।’এছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট,জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট,নারীর ক্ষমতায়ন,স্বাস্থ্য সেবা,টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি),সন্ত্রাসবাদ এবং সরকারের অন্তর্ভুক্তমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যার কথা গুলো স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন। স্পেন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল আয়োজিত ‘টুওয়ার্ডস এ ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার’ শীর্ষক একটি উচ্চ পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক, ‘মহামারি প্রতিরোধ,প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া’ (পিপিপিআর) বিষয়ে ইউএনজিএ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য,কানাডা,মালয়েশিয়া,গাম্বিয়া’র সাথে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক,এছাড়াও একাধিক রাষ্টপ্রধান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বমঞ্চেও নারীর ক্ষমতায়নের দাবি তুলে ধরেন।ইউএনজিএ প্লাটফরম অব উইমেন লিডারদের বার্ষিক সভায় নারী অধিকার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,‘আমাদের কর্মকান্ডকে অংশগ্রহণ থেকে নেতৃত্ব উন্নীত করতে হবে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অবশ্যই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।এটা দুঃখজনক যে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো নারীকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।সময় এসেছে,আমরা শিগগিরই একজনকে পাবো।নারীদের জীবনে ইতিবাচক সিন্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে তাদের অবশ্যই নেতৃত্বের অবস্থানে থাকতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের জাতিসংঘ সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্টর নৈশভোজে অংশগ্রহণ।নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে ‘দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট’-মিলনায়তনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনের রাষ্ট্রীয় ডিনার পার্টিতে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের(সিভিএফ)থিম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
কমিউনিটি ক্লিনিককে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বিশেষ সম্মাননায়’ ভূষিত করা হয়।ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিকেল স্কুলের মেডিসিন অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের ডিন ডা.মুকেশ কে জৈন প্রধানমন্ত্রীর কাছে সম্মানসূচক প্রশংসাপত্রটি হস্তান্তর করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাও প্রতিবারই সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য দিয়েছেন।বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক বাংলা ভাষায় কখনো বক্তব্য রাখেন নি।বিএনপি দেশপ্রেমের কথা বলে অথচ বেগম খালেদা জিয়া ১০ বছরের ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনবার(১৯৯৩,২০০২,২০০৫)জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান করেন।তিনি একবারের জন্যও বাংলায় ভাষণ দেননি।এছাড়া জিয়াউর রহমান,হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ও ড.ফখরুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করেছেন,তাঁরাও একটি বারের জন্যও বাংলায় ভাষণ দেননি।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবারের ভাষণ দিয়ে তিনি সর্বমোট ১৯ বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন।দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করে টানা তিন মেয়াদে পনের বছরে ১৫ বারই(১বার ভার্চুয়াল) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছেন।এর আগে প্রথম মেয়াদে ১৯৯৬-০১ সময়কালে চার বার সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণ করেছিলেন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগে জাতিসংঘে ১৬ বার বক্তব্য দেওয়ার রেকর্ড করেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ।সেদিক থেকে জাতিসংঘে সর্বাধিক সংখ্যক বার ভাষণ দেওয়ার রেকর্ড একমাত্র শেখ হাসিনার।এমন রেকর্ড উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের আর কোনো সরকার প্রধান অর্জন করতে পারেনি।অভিনন্দন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই