Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নূরু ভাই: পণ্ডিতজনের বিদায়

মনজুরুল আহসান বুলবুল
৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:০২

ড. আ বা ম নূরুল আনোয়ার। অধ্যাপক নূরুল আনোয়ার। আমাদের নূরু ভাই । আড়ালে আবডালে সতীর্থরা বলতেন ‘নূরেন্দ্র নাথ ঠাকুর’। কেন, পরে বলছি। তিনি ছবি হয়ে গেলেন। একটা ভালো ছবি খুঁজে পেলাম না, ধার করলাম স্নেহভাজন পলাশের কাছ থেকে।

নূরু ভাইয়ের বিদায় একই সাথে বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা, সঙ্গীত ও ক্রিকেট জগতের একজন প্রকৃত পণ্ডিতজনের বিদায়। এই তিন বিষয়ে তিনি কত বড়মাপের পণ্ডিত ছিলেন তা নিয়ে আলোচনার যোগ্য মানুষ আমি নই। তবে অনুধাবন করতে পারি।।

নূরুভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেই পারি। আমরা তখন আমাদের উন্মাতাল যৌবন নিয়ে ছুটে বেড়াই জ্ঞানের অন্বেষণে। কোনো বিষয় বাদ নেই। মার্কসবাদ থেকে রবীন্দ্র নাথ, ক্রিকেট থেকে সমাজ বিপ্লব, সৃষ্টির অপার রহস্য থেকে বিজ্ঞান, ধর্ম আর দর্শনের অলিগলি। সব কিছুই জানতে চাই, সব নিয়ে বিতর্ক করি।

এসব নিয়ে ‘মুক্ত বাতায়ন পাঠ চক্রের সংস্কৃতি সপ্তাহ। ঠিক হলো একদিন হবে বাংলা গান নিয়ে আলোচনা। অবধারিতভাবে মূল আলোচক নূরু ভাই। প্রতিদিন আলোচনা শেষে মূল আকর্ষণ গান,নাচ বা অভিনয়। আমি অ-সুর প্রজাতির কিন্তু সাংগঠনিক কারণে লেগে থাকতে হয় সব কিছুতেই। নির্ধারিত দিনে বাংলা গান নিয়ে আলোচনার সূচনা বক্তব্য দিলেন অধ্যাপক যতীন সরকার। এবার অনুষ্ঠানের সূত্রধর আমি আহ্বান জানালাম নূরু ভাইকে। তিনি তৈরি হয়েই এসেছিলেন। সঙ্গে হারমোনিয়াম। দাঁড়িয়েই মুখভরা হাসি ছড়িয়ে বললেন: আমি আলোচনা করবো বাংলা গানের তিনশ’ বছরের ইতিহাস নিয়ে, কিছু গানও শোনাবো। গান নিয়ে পান্ডিত্য আকাশছোঁয়া হলেও তাঁর গানের গলা সময় চলতি শিল্পীদের মত ছিল না। সেই তিনি শুরু করলেন। আমার পাশে বসা দুই বন্ধু অরুন ভট্টাচার্য নয়ন এবং মাসুদ বিবাগী (দুজনেই আজ প্রয়াত) আমাকে খোচা দিয়ে বলছে: নূরু ভাই যদি তিনশ’ বছরের বছরওয়ারী একটা করে গানও গায় ‘তাইলে আইজ বাড়িত যাওন লাগতো না, তুই সাধারণ সম্পাদক তুই শেষ পর্যন্ত থাহিস, আমরা নাই’। সবার আশংকা সেই রকমই ছিল। কিন্তু অনেকের হয়তো বিশ্বাস হবে না, আড়াই- তিনঘন্টার মধ্যে বাংলা গানের তিনশ’ বছরের বিবর্তন কিছু কথায়, কিছু তালে, কিছু সুরে নূরু ভাই সবাইকে আটকে রাখলেন। বাংলা গান নিয়ে এমন কোন আলোচনা আমি আর কোথাও শুনিনি। বাংলা লোক গানের প্রতিটি তাল লয় শব্দ যে সাধারণ বাঙালীর জীবনেরই স্পন্দন সেটি নূরু ভাইয়ের সেদিনের আলোচনা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। তিনিতো রবীন্দ্র নাথের এনসাইক্লোপিডিয়া।

আমার সাংবাদিকতা জীবনের নানা পর্বে রবীন্দ্র নাথের বহু বিষয় নিয়ে ঢাকার বহু পন্ডিতদের নানা তথ্য নূরু ভাইয়ের কাছ থেকে আরেকবার ঝালিয়ে নিতাম। আমার লাভ হতো বিষয়টির নাড়ী নক্ষত্র জেনে আমি সমৃদ্ধ হতাম।

ক্রিকেটের কত বছরের তথ্য উপাত্ত যে তার মাথায় ছিলো সেটি কল্পনা করাও আমার পক্ষে অসাধ্য। ময়মনসিংহের দাপুটে সাংবাদিক আমি, সহযোদ্ধা প্রণব রাউত। প্রণব রাউত সে সময় ঢাকার বড় সংবাদপত্রের ক্রীড়া সাংবাদিকদের পাশাপাশি ক্রীড়া পর্যালোচনা লিখতেন। নূরু ভাই পড়তেন এসব, পরামর্শও দিতেন। তার সাথে আড্ডায় বসলে রবীন্দ্র নাথ আর ক্রিকেটে ঘেরা থাকতো চারদিক। সেই রকম এক আড্ডায় নূরু ভাইয়ের বাসায় প্রণব রাউত আর আমি। নিবিষ্ট শ্রোতা পেলে নূরু ভাই ব্যাট করতেন হাত খুলে, চার ছক্কার নীচে নয় । সেদিনও তাই। শুরু অবশ্যই রবীন্দ্র নাথ দিয়ে, তারপর ক্রিকেটের পূর্বাপর তথ্য, পরিসংখ্যান, নানা দল, প্লেয়ার, মাঠ ও আম্পায়রদের নিয়ে কত কথা। এই সব বলার সময় তার দেহভঙ্গী অদ্ভুত, যেন আমরা মাঠে বসে খেলা দেখছি। আকর্ণবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে বললেন: হুন, প্রথমবার লন্ডন গিয়া বিমান থাইক্যা নাইম্যাই টেক্সী কইরা গেছি লর্ডসে, মাথা ছোয়াইয়া প্রণাম কইরা পরে গেছি অন্যকামে। ঐ যে কয়না লর্ডস হইলো ক্রিকেটের মক্কা। হা হা। নূরু ভাইয়ের সেই অট্টহাসি। দুই ঘন্টা একাই লাগাতার কথা। এক পর্যায়ে আমাদের উসখুস ভাব দেখে বললেন: তোমরা কি চা খাইবা। আমরা রাজী হলাম, এরও প্রায় আধাঘন্টা পরে নূরু ভাইয়ের হাঁক, দিলরুবা, দিলরুবা ( ভাবীর নাম ) এই যে বুলবুল আর প্রণবরে চা খাওয়াইতা না। তারও ২০/২৫ মিনিট পরে ভাবীর আবির্ভাব দৃশ্যপটে: চা খাইলে পাতা আনন লাগবে।

অত্যন্ত সরলভাবে নূরু ভাইয়ের প্রস্তাব: লও যাই, মাচ্ছা বাজারে যাই, চা পাতা আনিগা। প্রণব দা’ আমাকে আস্তে করে বললেন, ভাগনের এইডাই ফাঁক, নাইলে চা পাতা আইন্যা বইলে দিন শ্যাষ। আমরা কেটে পড়ি নূরুভাইকে ফাঁকি দিয়ে । কিন্তু আমাদের মাথায় গেঁথে থাকে রবীন্দ্র নাথ আর ক্রিকেটের অসাধারন যুগলবন্দী, যার চিত্রকর আমাদের নূরু ভাই।

নূরু ভাই কি রাজনীতি করতেন জানিনা, কিন্তু ময়মনসিংহ শহর আর কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল রাজনীতির আড্ডাগুলোর সাথে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। তার সব বন্ধুরা ছিলেন সেই জগতেরই।

রবীন্দ্র নাথ, সঙ্গীত আর ক্রিকেট ছিল তার কাছে পবিত্রতম বিষয়। এসব প্রশ্নে তিনি আপস করতেন না ।

আমরা মাঝে মধ্যে দূর্গাবাাডী রোড বন্ধ করে মন্চ বানিয়ে আলোচনা আর নাচ, গানের অনুষ্ঠান করতাম। নূরুভাই পছন্দ করতেন না। বলতেন, সংস্কৃতি হচ্ছে মন ও মননের বিষয়, মন তৈরি না করে মননে তা’ ঢুকিয়ে দেয়া যাবে না, মগজেও না। রাস্তা বন্ধ করে অনুষ্ঠান করা যাবে কিন্তু লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। তার এই কথা সবাই মানতেন এমন হয়।

জীবিকার জন্য তিনি চাকরী করতেন কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়ে কিন্তু তার উপাসনায় ছিল রবীন্দ্র নাথ, সঙ্গীত আর ক্রিকেট। তার মৃত্যুতে এই তিন জায়গাতে কতটা ক্ষতি হলো তা পরিমাপের যোগ্য আমি নই। কিন্তু এই দেশ যে একজন খুবই বড়মাপের সংস্কৃতিবান নিখাদ ভালো মানুষকে হারালো তা’ নিয়ে কোনই সন্দেহ নাই। রাষ্ট্র তাকে সন্মানিত করুক এই দাবী করি।

অধ্যাপক আ বা ম নুরুল আনোয়ার ছিলেন একাধারে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী, গবেষক, শিক্ষক ও ক্রীড়া সংগঠক। তিনি ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে অনেক রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর তৈরির মূল কারিগর। ঢাকা ছায়ানট ও ইউডা’র সংগীত বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন৷ তিনি ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনন্দ ধ্বনি ও শিশু তীর্থ নামে সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অধ্যাপক আ বা ম নুরুল আনোয়ার বুধবার দুপুর আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানী ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাতে ময়মনসিংহের গোলকিবাড়ি কবরস্থানে মরহুমের নামাজের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।

নূরু ভাই আপনার অবিরাম আলোচনা থেকে পালাতে চাইতাম, আজ আর চাইলেও তা’ শুনতে পাবো না, এই কষ্ট নিয়েই কাঁটবে বাকি জীবন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

নূরু ভাই: পন্ডিতজনের বিদায় মত-দ্বিমত মনজুরুল আহসান বুলবুল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর