Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কৃষি ও কৃষকের জন্য স্মার্ট উদ্যোগ

ড. মো. মোতাহার হোসেন
৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৫৩

জলবায়ু বিপর্যয়, বৈশ্বিক মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে কৃষি খাতের অবদান বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের অর্থনীতিতে সেবা এবং উৎপাদন খাতের অবদান বাড়লেও কৃষি খাত এখনও খাদ্য উৎপাদন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস। বর্তমানে কৃষি খাত মোট শ্রম বাজারের ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান এবং ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে আসছে।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কৃষিবান্ধব সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে গত এক দশকে কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ধান উৎপাদনে তৃতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, পেয়ারা, কাঁঠাল, আম উৎপাদনেও বিশ্বের সেরা দশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম। সারা বিশ্ব যখন খাদ্য সংকটের আভাস দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে পণ্যের দাম, তখনও আমাদের ভরসার যায়গা সেই কৃষি।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলছেন, এক টুকরো জমিও ফাঁকা রাখা যাবে না। অথচ নিদারুণ সত্য এই যে, প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমি। কৃষিতে উৎপাদন ধরে রাখতে তাই সব রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে বর্তমান সরকার। উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার, কৃষি উপকরণ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভর্তুকিকরণের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকিকরণের ব্যাপক প্রসার, সেচ কাঠামো নির্মাণ, কৃষি ঋণ প্রাপ্তির সহজিকরন ইত্যাদি পদক্ষেপ কৃষির উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তেমন একটি উদ্যোগ হলো কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড।

কৃষকদের হাতে কৃষি উপকরণসহ অন্যান্য সাহায্য সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকার কৃষি কার্ডের মত চমৎকার একটি কর্মসূচি শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে প্রথম নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতি ইউনিয়নের কৃষকদের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে সেচ কাজে ডিজেল ক্রয়ের জন্য নগদ অর্থ ও কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধনের মাধ্যমে এধরনের কার্ডপ্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। এ সময় ২০ জন কৃষকের মাঝে ভর্তুকির চেক প্রদান করা হয়। সেই থেকে, কৃষি উপকরণ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে কৃষিবান্ধব এ সরকার সারাদেশে এ পর্যন্ত মোট ২ কোটি ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৯ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ কার্ড প্রদান করেছে। প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি এই তিন ধরনের কৃষক কার্ডের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন।

যাদের ৫ শতক থেকে ৪৯ শতক জমি আছে তারা প্রান্তিক চাষি, যাদের ৫০ শতক থেকে আড়াই একর জমি আছে তারা ক্ষুদ্র চাষি এবং যাদের আড়াই একর থেকে সাড়ে সাত একর জমি আছে তারা মাঝারী চাষি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। কৃষকরা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খুলে তার মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ সহায়তা, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি ও ঋণ সহায়তার মতো সেবা নিতে পারছেন। কৃষকদের জন্য এই প্রণোদনা কৃষি এবং কৃষকের প্রতি সরকারের গভীর আন্তরিকতার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ।

তবে গ্রামাঞ্চলে কৃষি কার্ড বাছাইকরণ ও বিতরণে যেন কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এছাড়া এই কার্ড ব্যবহার করতে গিয়ে কৃষকদের অভিজ্ঞতাজনিত কিছু ভোগান্তিতে পড়ার সুযোগ যেন কেউ না তৈরি করে সেদিকেও দৃষ্টি থাকতে হবে।

স্মার্ট কৃষি কার্ড ব্যবহার করে প্রত্যেক কৃষকের জন্য এলাকা ও চাহিদাভিত্তিক কৃষিসেবা দেওয়া হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কৃষিতথ্য নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিজিটাল কৃষি প্রোফাইল তৈরি, স্মার্ট কৃষি কার্ড বিতরণ, ডিজিটাল কৃষিতথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে কৃষকের কৃষি উৎপাদনের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে। কৃষকরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রণোদনা নিতে পারবে এই কার্ড দেখিয়ে। একই সঙ্গে কৃষিতে সরকারের সার, বীজসহ যত ধরনের প্রদেয় সুবিধা আছে, স্মার্ট কার্ড দেখিয়ে সেসব সুবিধা নিতে পারবে কৃষকরা।

এ প্রকল্পের আওতায় যেহেতু দেশব্যাপী কৃষকদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করে তাদের মধ্যে স্মার্ট কার্ড বিতরণ করা হবে, সেহেতু প্রকৃত কৃষকরাই সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিতে পারবেন। ধান ও ধান-ভিন্ন অন্যান্য ফসলের আবাদ সম্প্রসারণে প্রকল্পের আওতায় যথাযথ প্রযুক্তিগত ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। খাদ্য রফতানির ক্ষেত্রেও আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্যের মান নিশ্চিত করা হবে। চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া কৃষি খাতের সর্ববৃহৎ এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের কৃষিখাতে যান্ত্রিকিকরণ, বৈচিত্র্যকরণ ও সমন্বিত মূল্যচক্র যোগ হওয়ার মাধ্যমে ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন সাধিত হবে, যা পরিবেশগতভাবে দেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় অবদান রাখবে। এক লাখ হেক্টর নতুন জমিতে উন্নত এবং দক্ষ সেচ প্রযুক্তির প্রচলন এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে কৃষি উদ্যোগকে জনপ্রিয় করতে ২০ হাজার নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

যেভাবে অধিক লাভবান হবে কৃষকরা

সারা বছর ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে কিংবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলান কৃষকরা। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো— ফসল উৎপাদন ও বিপণনে নানারকম সমস্যায় পড়েন তারা। এসকল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কৃষি ও কৃষককে একসঙ্গে একটি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্যোগই হলো এই স্মার্ট কৃষি কার্ড। এর মাধ্যমে অধিক লাভবান হবে কৃষকরা। এই ডিজিটাল প্রোফাইল ব্যবহার করে কৃষকরা বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ নিয়ে যেমন ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পারবে, তেমনি শঙ্কা কাটবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিয়েও। একইসঙ্গে এই কার্ডে থাকা বারকোড স্ক্যান করে একজন কৃষকের সব তথ্যই যাচাই করা সম্ভব হবে। ফলে সরকারের দেওয়া সকল সুবিধা পাবেন প্রকৃত কার্ডধারীরা। অন্যদিকে কৃষকদের নাম ভাঙিয়ে কেউ ঋণ নিয়ে তাদের বিপদে ফেলতে পারবে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃষকের সঙ্গে সম্প্রসারণ কমিটি ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের যোগাযোগ, তথ্যের আদান-প্রদান ও এলাকাভিত্তিক চাহিদা অনুযায়ী সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এছাড়া অ্যাপসে সংরক্ষিত ডিজিটাল কৃষি তথ্যের সাহায্যে ফসলের উৎপাদন পরিকল্পনা ও বাজারজাতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কৃষকরা নিজেই। সেইসঙ্গে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে নারী কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সচেতনতা ও দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করা সম্ভব হবে।

এই প্রকল্পের আওতায় দেশের পাঁচ কোটি কৃষকের মধ্যে থেকে প্রথম পর্যায়ে এক কোটি ৬২ লাখ কৃষককে ডিজিটাল প্রোফাইলে যুক্ত করা হবে। পাশাপাশি এক কোটি ৯ লাখ কৃষককে দেওয়া হবে স্মার্ট কৃষি কার্ড। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে সরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়সহ ১৪টি কৃষি অঞ্চলের ৯টি জেলা, গোপালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বরিশাল, যশোর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বান্দরবান ও ময়মনসিংহের সকল উপজেলা এবং মেট্রোপলিটন এলাকার কৃষকদের মধ্যে এই স্মার্ট কৃষি কার্ড বিতরণ করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে অন্য কৃষি অঞ্চলের কৃষকদের এই সেবার আওতায় আনা হবে।

স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকরা বিভিন্ন প্রকার হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি সকল প্রকার অব্যবস্থাপনা কমিয়ে কৃষকদের জন্য সরকার নির্ধারিত সুযোগ সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে পৌঁছানো সম্ভব হবে। আর এতেই সুফল মিলবে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় এবং উন্নয়ন হবে কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার। বেগবান হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দারিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঠিক পথে এগিয়ে চলা।

লেখক: পরিচালক, আইকিএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর