অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার প্রয়োজন
৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৩০
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার চালানো প্রয়োজন কেন? গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অর্থ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, কুৎসা ও গুজব রটনা করা। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দেশ বিরোধী অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। র্যাশনাল যুক্তি সহকারে এইসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনগণ ও বিশ্ববাসীকে সঠিক তথ্য ও উপাত্ত অবগত করানোর লক্ষ্যে পাল্টা প্রচার চালানো প্রয়োজন।
পশ্চিম দুনিয়ায় বিশেষত গ্রিক নগর রাষ্ট্র এথেন্সে প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ‘অলঙ্কারশাস্ত্র’ বা রেটরিক (গ্রীক: “বক্তাদের কৌশল”) শিক্ষা দিয়ে প্রচারের পদ্ধতিগত, বিচ্ছিন্ন এবং ইচ্ছাকৃত বিশ্লেষণ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। নৈতিক শিক্ষক আইসক্রেটিস (৪৩৬-৩৩৮খ্রিষ্টপূর্ব), প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৮/৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) এবং অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্ব) তাদের নিজেদের এবং তাদের ছাত্রদের আরও বেশি যুক্তি তৈরি করার জন্য অলঙ্কারশাস্ত্রের নিয়মগুলি সংকলন করেছিলেন (১) বিরোধীদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারের জন্য প্ররোচিত করার কৌশল এবং (২) ডিজাইন করতে শেখানো এবং (৩) তাদের ছাত্রদের শেখানো কিভাবে যুক্তিসিদ্ধভাবে মিথ্যাচার এবং গণবক্তা বা ডেমাগগ এর মানসিক আবেদন সনাক্ত করতে হয়।
যথাযথ যুক্তি বা আকর্ষণীয় স্লোগান নিজে থেকে মানুষের আচরণ প্রভাবিত করতে পারে না। মানুষের আচরণ অন্তত চারটি চলক বা ভেরিয়েবল দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রথমটি হল প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের প্রবণতা অর্থাৎ তাদের জমানো স্মৃতি এবং সম্পর্কিত প্রতীকগুলির সাথে তাদের অতীতের সম্পর্ক। এগুলি প্রায়শই প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদেরকে প্রতীকগুলির চলমান প্রবাহ উপেক্ষা করতে খুব বেছে বেছে তাদের উপলব্ধি করতে বা তাদের যুক্তিযুক্ত করার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। দ্বিতীয়টি হল আর্থিক প্রলোভন (উপহার, ঘুষ, বেতন বৃদ্ধি, চাকরি হারানোর হুমকি, এবং আরও অনেক কিছু) যা প্রচারক বা অন্যরা প্রতীকগুলির সাথে একত্রে প্রয়োগ করতে পারে। তৃতীয়টি হল প্রচারকার্যে নিয়োজিতরা বা অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত বস্তুগত প্রলোভন (প্রেম, সহিংসতা, সহিংসতা থেকে সুরক্ষা)। চতুর্থটি হল প্রচারকার্যে নিয়োজিতদের চিন্তা বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের পক্ষে সামাজিক চাপ।
জার্মানির ড. পল জোসেফ গোয়েবলস হিটলারের সময় ১৯৩৩ হতে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নাৎসিদের প্রপাগান্ডামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেষে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। গোয়েবলসের আলোচিত উক্তি ছিল, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’
একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। র্যাবের একটা ভিডিওতে লেকে মরা মাছ ভেসে থাকার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। মানুষ ভিড় করে দেখছে। এক পথচারী জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই কী হয়েছে? উত্তরে উপস্থিত আরেকজন বললেন, লেকে মরা মাছ ভাসছে। সেই লোকের মনে হলো লেকে লাশ ভাসছে। দূর থেকে মোবাইলে লেকের ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিল ‘লেকে লাশ ভাসছে’। মুহূর্তে গুজব ছড়িয়ে পড়ল গোটা শহরে, ‘লেকে মরা লাশ ভাসছে’। তেমনি গার্মেন্ট কারখানায় মশার ওষুধ ছিটানোর ধোঁয়া দেখে ছবি তুলে আরেকজন ফেসবুকে লিখে দিলে, ‘আগুন লেগেছে গার্মেন্টে’। ব্যস, আর যায় কোথায়? সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল আগুন নিয়ে। হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে হতাহত গার্মেন্টের মেয়েরা। এমনও হাজারো গুজব ছড়ানো হচ্ছে এখন সমাজে। কিছু লোকের কাজই হলো বাজেভাবে সমাজে গুজব ছড়ানো।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বিভিন্ন দিক প্রচার করা, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করানো, করোনা বৈশ্বিক মহামারী চলা কালে জনসাধারণের করণীয় সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ প্রভৃতি সঠিকভাবে জনসাধারণকে অবগত করানো এসবই প্রচারের অংশ।
অপরদিকে জনমতকে মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করাকে অপপ্রচার বা কখনো কখনো প্রোপাগান্ডা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। চলমান পরিস্থিতিতে এইসব অপপ্রচারের ভিত্তি হচ্ছে গুজব। যেমন ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানী ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং তথ্য বিকৃতি করা এবং সাঈদীকে চাঁদে দেখা গিয়েছে বলে মিথ্যা প্রচার করা এসবই প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার। শাপলা চত্বরের ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকরভাবে অপপ্রচারের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় আদিলুর রহমান খান ও তার প্রধান সহযোগী নাসির উদ্দিন এলানের ২ বছর করে কারদণ্ড হয়। সেই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
এইসব আলোচনা থেকে বোঝা যায় যা ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে, যেসব যুক্তি বা কুযুক্তি দেয়া হয় বা হচ্ছে, যেসব গুজব ছড়ানো হয়, যেসব সত্য, অর্ধসত্য বা মিথ্যা বলা হয় তার সবই কোনটা প্রচার বা পাবলিসিটি আবার কোনটা অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডা। প্রচার বা অপপ্রচার প্রায়ই গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনসাধারণকে অবগত করানো হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা প্রচার আর কোনটা অপপ্রচার তা কীভাবে চিহ্নিত করা যায়? আর এজন্য অর্থাৎ অপপ্রচারের দৌরাত্ম থেকে পাবলিক সেন্টিমেন্টকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত ব্যক্তিবর্গের সক্রিয়তা প্রয়োজন।
২০১১ জুলাইয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। সংবিধান ছুড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত থেকে বিএনপি এক চুলও সরে আসে নাই। তার মানে বিএনপি একটি ভয়াবহ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কর্তৃক বিনা বিচারে সংবিধান বহির্ভূতভাবে সেনাবাহিনীর অসংখ্য সদস্যদের ফাঁসি দেয়া, সেনাবাহিনী প্রধান থাকাকালে সেনা আইন লঙ্ঘন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, ‘হাঁ’ ‘না’ ভোট নামে প্রহসনের নির্বাচন করা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অবৈধভাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চিরতরে বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি আইন পঞ্চম জাতীয় সংসদে ‘ভুয়া’ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করানো, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়া প্রভৃতি সবই অসাংবিধানিক কাজ।
পাশাপাশি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশের প্রথম সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। অতএব অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পূর্ব অভিজ্ঞতা বিএনপির আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন বিএনপি এখন সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিতে চায়? কারণ আদালতের রায় অনুসারে অবৈধভাবে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল এবং শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য পথ তৈরী করা হয়েছে, ইসলাম ধর্মের সাথে সাথে অন্যান্য ধর্মকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে, তত্ত্বাবধায়কের মত একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বাতিল করা হয়েছে ইত্যাদি। বিএনপির এই সংবিধান বিরোধী অবস্থানের জবাব দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তথা বিজয় দিবস থেকে বলবৎ হয় এবং ওই দিনই গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘটে। গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এই সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানের বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান। অতএব বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রকৃত অনুসারীদের বিএনপির সংবিধান ছুড়ে দেয়া সংক্রান্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য সংবিধান সংশোধনের জন্য কমিটিতে বিএনপির লোক চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে তারা সাড়া দেয় নাই। কমিটি খলেদা জিয়ার কাছে দুই দুই বার মতামত জানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেন নাই। এমন কি কোন লিখিত প্রস্তাবও দেন নাই। এসময় খালেদা জিয়া বলেছিলেন সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রণীত কমিটি অবৈধ। সবই অবৈধ! শুধু বৈধ খালেদা জিয়া এবং জে: জিয়ার শাসন আমল? আবার যখন সংবিধানের সংশোধনী বিল সংসদে উঠানো হলো সেখানেও বিএনপি সদস্যরা যান নাই। সংসদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম উপস্থিতির বিরোধী নেত্রীর রেকর্ডটিও বেগম খালেদা জিয়ার। সংসদে জনগণের সাথে ভাওতাবাজী বিএনপির মজ্জাগত।
১৯৭৫ সালে নির্বাচিত সরকার প্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি সবচেয়ে বড় আঘাতটি করা হয়েছিল। সেই সাথে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পরে ইনডেমনিটি আইনের মাধ্যমে মানবাধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘন করা তথা আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। এভাবে অতীতে নানান ঘাত-প্রতিঘাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশের গণতন্ত্র এখনও বিকাশমান ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দেশের মানুষ ১/১১ এর স্মৃতি এখনও ভুলে যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে বিএনপি ২০০৬ সালের শেষ দিকে যেনতেন নির্বাচন দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিলো। ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার যুক্ত করে ক্ষমতায় টিকে থাকার অপপ্রয়াস চালায়। যারা এগুলো করেছিল তারা এখন বিশেষত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশ বিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সহকারে ‘পাল্টা প্রচার’ যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষকে এগিয়ে আসা অপরিহার্য।
স্মরণ করা যেতে পারে যে বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১৩-১৪ সালে যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন ও লঞ্চসহ বহু ধরনের যানবাহনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে জনগণকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে, সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে সারাদেশে তান্ডব চালিয়েছিল, তথাকথিত আন্দোলনের নামে। অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নারীসহ অনেক লোক গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়েছিলো এবং তারা তাদের আঘাত নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে। এর আগে ২৯ জন পুলিশ সদস্যকে বিএনপি হত্যা করেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। দেশের জনগণ কখনই এইসব ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দিতে চায় না।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা
সারাবাংলা/এজেডএস
অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার প্রয়োজন অরুণ কুমার গোস্বামী