ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে মৃত্যুর মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে?
৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:০৬
লেখাটি যখন লিখছি ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ ফিলিস্তিনে তখন রোববারের ভরদুপুর। এর আগে, স্থানীয় সময় শনিবার ভোরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচাইতে ‘ভয়ংকরতম ও সফল’ ‘অপারেশন আল আকসা স্টর্ম’ হামলা করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। মূল হামলাটি হয়েছে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ইসরায়েলের বৃহত্তম শহর ও দেশটির অর্থনৈতিক, প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র তেল আবিবে। শুধু তেল আবিবই নয়; দেশটির রাজধানী জেরুজালেমেও পৌঁছেছে হামাসের রকেট। ইসরায়েলের ক্রমাগত দখল ও নির্যাতনের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা অর্জন এ অভিযানের লক্ষ্য বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র এই সংগঠনটি।
শনিবার ভোরে ইসরায়েলে যখন হামাসের হাজারও রকেটের বহর আঘাত হানে, দেশটিতে তখন স্থানীয় একটি উৎসবের ছুটি চলছিল। তেল আবিবের পুরো আকাশ ধোঁয়ায় ঢেকে, স্মরণকালের ভয়াবহ এই রকেট হামলায় নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের উত্তর ও দক্ষিণাংশের বিভিন্ন স্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে ফিলিস্তিন পাঁচ হাজারের বেশি বিভিন্ন পাল্লার রকেট ছোড়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইসরায়েল। এছাড়া হামাসের হামলায় বিস্ফোরক বোঝাই প্যারাগ্লাইডারও ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েলিদের কাছে আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত এই ঘটনার ‘চমক’ কাটতে না কাটতে সবাই বুঝতে পারছে- হামাসের এই হামলা এক দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল। কারণ শুধু রকেট হামলাই নয়, একইসঙ্গে সফলভাবে গাজা উপত্যকা থেকে বহু সশস্ত্র হামাস যোদ্ধা স্থলপথ, সমুদ্রপথ ও আকাশপথ ব্যবহার করে ইসরায়েলের দক্ষিণ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে বলে দাবি দুদেশেরই।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যে গোয়েন্দা কার্যক্রম ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোর একটি ইসরায়েলের এতো গর্ব- তারাও এই হামলার বিষয়টি আগে আঁচ করতে পারেনি। ছিল না কোনো সতর্কতাও। স্বাভাবিকভাবেই তেল আবিবের জনগণও হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কোনোভাবে।
এমনকি ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েলের গর্ব বিশ্বের অন্যতম সেরা ও অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’। এর অন্যতম কারণটি হচ্ছে ভূমধ্যসাগরের পাড়ের দেশ দুটিতে হামলার ঐতিহ্য কিন্তু পরিবর্তিত হয়নি। কেবল বদলে গেছে হামলার প্যাটার্ন। এর আগে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসরায়েল প্রথমে হামলা চালাত। আর প্রতিআক্রমণ করত ফিলিস্তিনিরা। এবার সেই মিউজিক্যাল চেয়ারে বদল এসে আগেই ‘ইতিহাসের ভয়ংকরতম’ হামলা চালাল হামাস। হামাসের আগে আক্রমণের এই পরিবর্তন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী। আর এই বদলই আতংকিত করে তুলেছে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের।
হামলার প্রতিক্রিয়ায় যথারীতি চুপ করে বসে থাকেনি ইসরায়েল। তারা প্রাথমিকভাবে ‘অপারেশন আয়রন সোর্ড’ নামে অভিযানে অবরুদ্ধ গাজায় ভারী অস্ত্রের হামলা চালায়। শনিবার রাতেই ট্যাংক ও ভারি অস্ত্রসজ্জিত ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ঢুকে পড়ে। ইসরায়েলিরা গাজার অধিকাংশ এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা লক্ষ্য করে বিমান থেকে মুহুর্মুহু ছোড়া বিধ্বংসী রকেট-বোমায় ছেয়ে যায় গাজার আকাশ। জবাবে আরও রকেট ছুড়েছে হামাসও। কিন্তু প্রাথমিক ধাক্কা সামলে পরবর্তী হামলার রকেটগুলো সফলভাবে প্রতিহত করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। স্মরণাতীতকালের ভয়াবহতম এই হামলার পর ইসরায়েলজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ইসরায়েলের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুপক্ষে মৃত্যুর দাবি পাঁচ শতাধিক। এরমধ্যে ইসরায়েলের আড়াইশ’র বেশি আর ফিলিস্তিনে প্রায় তিনশ। আহত আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। এছাড়া হামাস ইসরায়েলের নিরাপত্তাবাহিনীর বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে জিম্মি করার দাবি করেছে। হামাসের দাবি, তারা ইসরায়েলের এই কর্মকর্তাদের বিনিময়ে ইসরায়েলে কারাবন্দী রাজনীতিবিদ ও সেনাসদস্যসহ ফিলিস্তিনি সব বন্দিদের ছাড়িয়ে আনতে চান। তবে আটক করা ইসরায়েলি সেনার সংখ্যা কত তা জানায়নি হামাস।
ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সবাই বুঝতে পারছে, ভূমধ্যসাগরের তীরে একটি বড় যুদ্ধ আসন্ন। স্মরণকালের ভয়াবহতম হামাসের এই হামলার পর ইসরায়েল যে চুপ করে বসে থাকবে না এটা বলাই বাহুল্য। এ ঘটনার জের গত দেড় বছরে বারবারই সৃষ্ট উত্তেজনায় দুদিনে মিটে যাওয়া ‘যুদ্ধের’ মতো হবে না। ইতোমধ্যেই ইসরায়েল ২০১৪ সালের পর দেশটির রিজার্ভ সৈন্যদের একাংশকে ডেকে পাঠিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট দ্রুত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ হামাসকে হারানোর ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে হামাসও চুপ করে বসে নেই। স্বাধীনতার লক্ষ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ তারা জন্য যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে। শুধু তাই নয় ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের মুসলিমের উচিত মানবতার এই যুদ্ধে শামিল হওয়া। টেলিগ্রামে দেওয়া এক বার্তায় হামাস পশ্চিম তীরের যোদ্ধাদের পাশাপাশি আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে এই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। দুপক্ষেরই এই যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির ফলশ্রুতিতে গাজায় মৃত্যুমিছিল বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈরিতার বিষয়টি নতুন করে বলার কিছু নেই। এই বৈরিতায় গত দেড় দশকে কেবল পশ্চিম তীর ও গাজা অঞ্চলে ১৪ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সবশেষ গত প্রায় দেড় বছরের বৈরিতায় বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল ভূমধ্যসাগর পাড়ের শহর গাজা ও তেল আবিবের মানুষগুলো। গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই হামাস ও পিআইজেসহ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘর্ষে গাজার বিভিন্ন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রতিনিয়তই ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এই হামলাগুলোতে অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর প্রায়শই দিয়ে আসছিল ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে ইসরায়েলি বাহিনীও অধিকৃত ভূখণ্ডে হামাস ও পিআইজের হামলার খবর প্রচার করেছে নিয়মিতই। এরই জেরে এপ্রিলে গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের যাতায়ত বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলিরা। ফলশ্রুতিতে দুপক্ষেই উত্তেজনা ছড়িয়েছিল বেশ। তাই একটি সংঘর্ষ অনেকটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু হামাস যে এতবড় আকারে হামলা চালাতে পারে সেটি আঁচ করতেই পারেনি ইসরায়েলিরা।
হামাসের এই হামলাকে বর্বরোচিত বলে কঠোর নিন্দা ও হামলা থামানোর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। হামলার নিন্দা জানিয়ে সংঘাতের দ্রুত সমাপ্তি চেয়ে আহ্বান জানানোর দলে আরও আছে, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সৌদি আরব ও তুরস্ক। ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে দেশটির নিজেকে রক্ষার অধিকার আছে বলে বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি ও বেলজিয়াম। হামাসের হামলায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও।
এদিকে হামলাকে সমর্থন জানিয়ে হামাসের পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সর্বোচ্চ নেতা আলী হোসেইনি খামেনির উপদেষ্টার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, হামাসের এই হামলা দখলদারদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের মনোবলকে শক্তিশালী করবে। আর আরব লীগের প্রধান হামলার বিষয়টি এড়িয়ে ইসরায়েলকে দখলদারিত্বের মনোভাব ত্যাগ করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে পাওয়া ‘ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষে দুপক্ষে নিহতের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক’– এ নিছকই সংখ্যা নয়। মানবতার বিপর্যয়ও। দুই দেশের অনুমিত এই যুদ্ধ ভূমধ্যসাগরের পাড়ে দুপক্ষেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে বেশ। ফিলিস্তিন অধিকৃত গাজা থেকে যেমন মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পুড়ে যাওয়া ঘর ফেলে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে; একই অবস্থা ইসরায়েল অধিকৃত তেল আবিবের দক্ষিণাংশেও। সেখানকার হাজারো মানুষ কেবল কম্বল ও খাবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে যাচ্ছে– এমন ভিডিও প্রচার করেছে সংবাদমাধ্যমগুলো।
বিশ্বের অন্য যুদ্ধগ্রস্ত দেশগুলোর মতোই মৃত্যুর এই সংখ্যাগুলো হয়তো অনেকেরই হৃদয় স্পর্শ করবে না। কিন্ত যারা আক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্থ তারাই কেবল বলতে পারবেন– লাশেদের এই সংখ্যার ভয়াবহতার গল্প। বাংলাদেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের আত্মিক সম্পর্কের জড় অনেক আগের। দেশহারা, নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের দুঃখে এই সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের বাঙালির মন কাঁদে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কেউই এখনও কোনো শব্দ করেননি। হয়ত সময় নিচ্ছে সবাই। ওদিকে ঝরছে প্রাণ। অবিরত। যেমনটি ঝরেছে গত ৭৫ বছর ধরে।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে মৃত্যুর মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে? মত-দ্বিমত সন্দীপন বসু