Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদ্মাসেতুতে রেলযাত্রার স্বপ্নপূরণ

তাপস হালদার
১০ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:৩৪

পদ্মার বুকে সাফল্যের আরেকটি পালক যুক্ত হলো। ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প উদ্বোধন করলেন। এর মধ্য দিয়ে আরেকটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আত্ম মর্যাদা ও গর্বের প্রতীক। গত বছরের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছিলেন। এক বছর সাড়ে তিন মাস পর উদ্বোধন হলো রেল সেতু।

বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ১৮ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার বাকি টাকা দিবে চায়না এক্সিম ব্যাংক। ২০১৬ সালে সরকার পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ঢাকা-যশোর রেল প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। ১৪ অক্টোবর-২০১৮ সালে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ’ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা-যশোর ১৭২ কিলোমিটার প্রকল্পের ফরিদপুর পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথের উদ্বোধন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাকি প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

ঢাকা-যশোর রেললাইনটি নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলার উপর দিয়ে যশোরের সাথে যুক্ত হবে। রাজবাড়ী থেকে ভাঙ্গা হয়ে ঢাকার সাথে যুক্ত হবে আরেকটি রেল সংযোগ। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে ঢাকা-যশোর দুরত্ব কমবে ১৮৫ কিলোমিটার, ঢাকা-খুলনা ২১২ কিলোমিটার ও ঢাকা-দর্শনার ৪৪ কিলোমিটার। এখন পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-খুলনা রুটে দুইটি আন্তঃনগর ট্রেন (সুন্দরবন ও চিত্রা), ঢাকা-বেনাপোল রুটে (বেনাপোল এক্সপ্রেস), ঢাকা-কলকাতা রুটে (আন্তর্জাতিক মৈত্রী এক্সপ্রেস) চলাচল করবে। এসব ট্রেন এখন হার্ডিঞ্জ সেতু ব্যবহার করে ঢাকা আসতো। আন্তঃনগর ট্রেনে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে সময় লাগে ১১ ঘন্টা, কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে খুলনায় মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টায় এবং যশোরে তিন ঘন্টায় যাওয়া যাবে। দেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোল থেকে অতি সহজে পন্য আনা-নেয়া করা যাবে। পদ্মা রেল সেতু এমন ভাবে করা হয়েছে, যাতে যেকোনো পরিমান ভারি মালামাল বহন করা যাবে।এমন কি অদূর ভবিষ্যতে যদি দ্বিতল মালবাহী ট্রেন চালু হয়, তাও চলতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা-যশোর রেল প্রকল্পে বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো প্রবর্তন হয়েছে ২৩ কিলোমিটার এলিভেটেড ভায়াডাক্টে ব্যালাস্টবিহীন রেললাইন। পুরো পথে আছে ২৯ টি লেভেল ক্রসিং ও ৬০ টি মেজর ব্রিজ। এখানে ২ টি প্লাটফরম, ১ টি মেইনলাইন, ২ টি লুপলাইন ও লিফটসহ স্টেশন নির্মান করা হয়েছে। পদ্মা দোতলা সেতুর ওপরতলা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন, নিচ দিয়ে ট্রেন। সেতুর উভয় প্রান্তেই দেশের প্রথম ব্যালাস্টলেস বা পাথরবিহীন রেললাইন। ১১ মিটার উঁচু রেললাইনের নিচ দিয়ে আন্ডারপাস নির্মানের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মধ্যে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি উপরুট স্থাপনের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর ও নড়াইল জেলাকে নতুন ভাবে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্তকরণ করা হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকটি রুট বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দরকে যুক্ত করা হবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি পন্য রেলে ঢাকায় আসা-যাওয়ার পথ সুগম হবে। এতোদিন পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় রেল নেটওয়ার্ক ছিল না বলে সেখানকার মানুষ স্বল্প ব্যয়ে, নিরাপদ ও আরামদায়ক রেল সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। এখন পদ্মা রেল সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পর এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো।

২০৩৫ সালের মধ্যেই ৬৪ জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। দেশের ৪৩ টি জেলায় রেলপথ ছিল। এখন মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল যুক্ত হওয়ায় জেলার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ৪৭ টি। সরকারের এই মহাপরিকল্পনায় পদ্মা রেল সেতু মূখ্য ভুমিকা পালন করবে। এখনও বরিশাল বিভাগের পুরোটাই রেল যোগাযোগের আওতার বাইরে আছে। এই বিভাগকে রেলের আওতায় আনতে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। পদ্মা রেল সেতুর কারণে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। পণ্য পরিবহন সহজলভ্য হওয়ায় দেশের অর্থনীতিরও পরিবর্তন ঘটবে।

১৮৬২ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে রেল যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনীরা দেশের রেল, ব্রিজ কালভার্ট সব ধংস করে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিদেশী দেশ ভারতের সহায়তায় দ্রুত রেলপথ মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে কোনো সরকারই দিকে নজর দেয়নি। বরং সরকার গুলোর অবহেলার কারণে ভগ্নপ্রায় পরিবহনে পরিনত হয়েছিল। জনগণের মধ্যে রেল নিয়ে অনেক আফসোস ছিল। প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল – নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে? অথবা ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং/আইতে যাইতে কয়দিন?কখন ট্রেন ছাড়বে, কখন পৌঁছবে কেউ জানতো না। অথচ দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমন্বিত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার খুবেই প্রয়োজন। কারণ ঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেল চলাচলে সাধারণত বিঘ্ন ঘটেনা। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলপথের কোনো বিকল্প ছিলনা।

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরই রেলপথ যাত্রার উপর বিশেষ নজর দেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করে আলাদা রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। পুরনো রেলপথ গুলো পুনরায় চালু ও নতুন নতুন রেলপথ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। একই সঙ্গে নতুন লাইন স্থাপন, ইঞ্জিন ও বগি ক্রয়,বন্ধ হওয়া স্টেশন গুলো চালু করা হচ্ছে। উন্নত দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বুলেট, ইলেকট্রনিক ও দ্রুতগতির ট্রেন চালু সহ সব কয়টি জেলাকে রেলের আওতায় আনার কাজ দ্রুত গতিতে চলছে।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সমগ্র বাংলাদেশের যোগাযোগের সেতু বন্ধন তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে পর্যটন ও শিল্পায়নের আকাশচুম্বী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়ে গেছে। পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে রযেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ, খান জাহান আলীর মাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ অনেক দর্শনীয় স্থান। এক্ষেত্রেও রেল সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে।

পদ্মা রেল সেতু কেবলমাত্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, এটি বৃহৎ আন্তঃরেল যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশ। এই সেতুর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সাথে এশিয়ান হাইওয়ের গ্রুপে যুক্ত হয়। সেখানে নির্ধারণ করা হয় সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপে যাবে রেল। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পদ্মা রেল সেতুকে দ্বি-তলা সেতু করা হয়। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে এশিয়ার ২৮ টি দেশের সাথে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। অর্থাৎ পদ্মা রেল সেতু বিশ্বায়নের একটি সামগ্রিক রেল বিপ্লব এনে দিয়েছে। এই সেতু দিয়েই একদিন সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যাবে ট্রেন। আর এই নেটওয়ার্ক চালু হল ভারত, নেপাল, ভুটানে সরাসরি পন্য ও যাত্রী পরিবহনের দুয়ার খুলবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে রেলওয়ের সাথে করবে এই সেতু।

পদ্মা রেল সেতুটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। এর মধ্যদিয়ে ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পন্য পরিবহনে সুবিধা বাড়বে। খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। বদলে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

তাপস হালদার পদ্মাসেতু: রেল যাত্রার স্বপ্নপূরণ মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর