Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমেরিকা কি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চায়?

নিঝুম মজুমদার
১৭ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:১৪

আমেরিকা কি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চায়? এই প্রশ্নটি এখন বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের প্রশ্ন। এক কথাতে এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভব না। তবে এটা বলা যেতে পারে যে, আমেরিকা বিএনপিকে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

এ নিয়ে আলোচনার আগে ক্রিস্টোফার হিচিন্সের ‘দি ট্রায়াল অফ হেনরী কিসিঞ্জার’ গ্রন্থের (পেপারব্যাক এডিশন, পৃষ্ঠা-৭৪) একটি বক্তব্য কৌট করা যায়।
ক্রিস্টোফার হিচিন্স কিসিঞ্জারের খুব কাছের একজন কর্মকর্তা রজার মরিসের বয়ানে তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
‘In Kissinger’s view there was very much a distant hands-off attitude towards them. Since they had the audacity to become independent of one of my client states, they will damn well float on their own for a while’

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় লাইনটি গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকাকে এড়িয়ে গিয়ে দেশ স্বাধীন করবার বিষয়টিকে আমেরিকা বরাবর-ই ‘ঔদ্ধত্ব’ হিসেবেই দেখেছে। এ লেখার সূত্র হিসেবে আমেরিকান এই পুরোনো এটিচ্যুড গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামীলীগ যেভাবে বাংলাদেশকে পরিচালিত করেছে, সেই গতিকে বিশ্লেষন করে আমেরিকা যেটা খুঁজে পেয়েছে সেখানে দুটি ধারা তারা অনুমান করে নিয়েছে বলেই মনে হয়। সেগুলো হলো-

(১) বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের এই একক বিকাশ ও ক্রমাগত শক্তিশালী হওয়াটা এই অঞ্চলে তাদের (হেজিমনি) আধিপত্যবাদের জন্য গতিরোধক,

(২) বাংলাদেশ অন্তত গত ৬ থেকে ৭ বছর সময়ে নানাভাবে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তায় যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে এতে চীনের সাথে সম্পর্ক আরো অনেক বেশী গভীর হয়েছে এবং এই সম্পর্কের আরো কয়েক ধাপ লেয়ারে যে আওয়ামীলীগ ক্রমাগত ঢুকে যাবে তা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা আঁচ করতে পেরেছে। ফলে মার্কিন শক্তিবলয় আসন্ন নির্বাচনে হয় আওয়ামীলীগকে সরাও তা নাহয় আমাদের কক্ষপথে নিয়ে আসো, এমন প্রজেক্টে ধাবমান থাকবে।

বিজ্ঞাপন

এই অঞ্চলে ‘মিয়ানমার’ অভিজ্ঞতা মার্কিন সংস্থাগুলোকে আরো অনেক বেশী রি-এ্যাকশনারী করে তুলেছে কিংবা শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও নেপালের রাজনৈতিক নানাবিধ পটপরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোটে জয়ী হয়েছেন বিরোধী দল পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের (পিএনএস) মোহামেদ মুইজ্জু যাকে একজন চীনপন্থি নেতা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। উপমাহাদেশীয় এই ঠান্ডা যুদ্ধে চীনের এমন আক্রমনাত্নক ক্রীড়া নৈপুন্য মার্কিনিদের জন্য সুখকর নয়।

চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে এখনো পর্যন্ত অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির সাথে সমান্তরাল তা মার্কিনিদের কাছে স্পস্ট।

আমাদের সরল-সোজা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য এইসব ব্যাপারে রাখ-ঢাক করেন না। বিবিসি জানাচ্ছে যে (বিবিসি বাংলা অনলাইন, ১৩ অক্টোবর ২০২৩)

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি দাবি করেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানকে বলেছেন, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব আটকাতে হলে আমেরিকাকে ‘টাকা-পয়সা’ নিয়ে আসতে হবে।

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওয়াশিংটনে জ্যাক সুলিভানের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি তাকে বলেছেন “আপনারা খালি উপদেশ, আর হুকুম, আর ভয়… ও দিয়ে কিন্তু চায়নারে কনটেইন করা যাবে না। করতে হলে টাকা-পয়সা নিয়ে আসেন।

উনি আমাকে বললেন যে, উনি চেষ্টা করতেছেন, হি আন্ডারস্টুড ইট।”

মি. মোমেন জানান, মি. সুলিভান বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। একই সাথে তিনি (মি. সুলিভান) জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল তৈরি করতে চায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেয়ার জন্য।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে একটি বিষয় আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধানের কাছে খুবই স্পস্ট যে, বাংলাদেশে যদি চীনকে ছাপিয়ে আমেরিকা উন্নয়নের সঙ্গী হতে পারে তাহলে কূটনৈতিক চাপা-চাপির থেকে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হবে সম্পর্কের প্রধান নিয়ামক।

বর্তমান সরকার প্রণীত বাংলাদেশের ডেলটা প্ল্যান এই ক্ষেত্রে অনুধাবন করাটা জরুরী।

ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’কে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে সরকার।

বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে আলোচিত ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)।

ডেল্টা প্ল্যানে ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পনি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বন্য নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন। এই ছয়টি হলো ডেল্টা প্ল্যান-এর ছয় স্তম্ভ। (বাংলা ট্রিবিউন, ০৩ মে ২০২১, ১১:০০) এই পুরো প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য দরকার বিপুল অর্থের। এস্টিমেইটেড খরচ ধরা হয়েছে ৩৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে লক্ষ্যে আগাচ্ছেন সেটি হচ্ছে ২০৩০ সালের ভেতর বাংলাদেশকে একটি অতি কার্যকর কাঠামোর ভেতরে নিয়ে আসা।

অবকাঠামো থেকে শুরু করে সমস্ত ইন্ট্যাঞ্জিবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিকেই (আইনের শাসন, শিক্ষা, সামাজিক ব্যবস্থাপনার নানাবিধ স্তর) তিনি একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে বাংলাদেশকে একটা স্টেজে এনে দাঁড় করাতে চান।

গত ১৫ বছর বাদ দিলেও, গেলো ৫ বছরে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন হয়েছে সেখানে এই বাংলাদেশকে একজন মানুষের অচেনা লাগবেই। ব্যাপক রকমের উন্নয়ন ও তার সমাপ্তি দৃশ্যমান।

পদ্মা সেতু এবং সেখানে রেল লাইন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, এলিভেইটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ৬ লেইন, ৮ লেইনের সড়ক, শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রো রেইল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প।

মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পটুয়াখালীতে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লা ভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প।

পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রজেক্ট, গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।

ঢাকা শহরে সাবওয়ে নির্মাণ প্রকল্প,কচুয়া-বেতাগী সড়কে পায়রা নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি ছাড়াও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একের পর এক ফ্লাইওভার স্থাপন ইত্যাদি অসংখ্য প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের যে লক্ষ্য তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এই উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলোকে নিয়েই প্রবলভাবে সমালোচনা করছে বিএনপি সহ বিরোধীদলগুলো। এ থেকেই সহজে বুঝা যায় এই সরকারের কোন কোন ভিত্তিগুলো বিএনপির জন্য শংকার কারণ।

ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রচুর অর্থ। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল করবার জন্য একটা সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন যে প্রয়োজনীয় তা সরকার পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছে।

ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়নে অর্থের একটা বড় অংশ চীন থেকে আশা করা যায়। কেননা বিগত বছরগুলোতে এই উন্নয়নের যে অংশীদারিত্ব চীন নিয়েছে তা অভাবনীয়। বোধকরি এই অঞ্চলে ভারতের সাথে সমান্তরাল আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান পর্বে চায়নার এই বিনিয়োগ তাদের জন্যই নিরাপদ।

বঙ্গপোসাগর বেষ্টিত এমন ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চীনের যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকবে তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, এটি বলাটা বাহুল্য মাত্র।
ডেলটা প্ল্যান আর চীনের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক, এটি মার্কিন হেজিমনি বিকাশে অন্তরায়। বাংলাদেশ যেমন আজকে চোখে চোখ রেখে বলতে পারছে ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’, বাংলাদেশের এই বদলে যাওয়া চরিত্র মার্কিনিদের ‘নিতে পারা’ যেমন দূরহ তেমনি, বাস্তবতার নিরিখে ‘ভ্রু-কুঁচকে’ যাবার মত।

ফলে আব্দুল মোমেন সাহেব যখন সরাসরি মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বলেছেন, ‘টাকা নিয়া আসেন, তারপর দেখা যাবে’, তখন বাংলাদেশের এই মুলোমুলি করতে পারার সক্ষমতাপূর্ণ এটিচ্যুডকে আমেরিকা সেই কিসিঞ্জারের মত ‘ঔদ্ধত্ব’ হিসেবেই দেখবে বা দেখে।

নয়া উপনিবেশবাদ তত্বে আমেরিকার কূটনৈতিক সাম্রাজ্যেই তারা আমাদের যে অন্তরীন করে রাখতে চায়, এটা বুঝতে পারা রকেট সাইন্স নয়।

আমেরিকা বাংলাদেশের এই মহা পরিকল্পনার মধ্যে একটা গ্যাপ বা বিচ্ছেদ বা স্থবিরতা চায়। এখানে ভারতের মৌন সমর্থন রয়েছে কিনা সেটিও ভাবনার। গত কয়েকবছরে মার্কিনিদের নানাবিধ স্যাংশন, নানাবিধ পদক্ষেপে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত স্পস্ট।

যদিও এই সময়ে ভারতকে স্থির ও বাংলাদেশপন্থী বা বর্তমান সরকারপন্থী মনে হচ্ছে, তারপরও চীন ফ্যাক্টর ভারতকে এখনো জড়িয়ে রাখছে তাদের মন ও মগজে।

এত চেষ্টার পরেও বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দেয়নি, এটি অবশ্যই বাংলাদেশের চোখে চোখ রেখে কথা বলাটর সক্ষমতার একটা উদাহরণ বলা যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা এই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য হামলে পড়েছে এবং এতে যদি তারা সফল হয় তাহলে আমেরিকার হাতের পাঁচ কারা? বি এন পি?

তা মনে হয় না। আমেরিকার প্রথম চিন্তায় রয়েছে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সমন্বিত দল। যাদেরকে তারা আপাতত এই অঞ্চলে দেখতে চায়। এতে করে জিসোমিয়া থেকে শুরু করে আকসা চুক্তি এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে তারা চীনের বিরুদ্ধে যে প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে সেটি নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারবে। মার্কিনিদের একটা দীর্ঘ মেয়াদী সময় নিয়ে বাংলাদেশ বিষয় ‘সর্ট-আউট’ করার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

হঠাৎ করে ডক্টর ইউনুস বিশ্ব নেতাদের নিয়ে যে বিবৃতি বিবৃতি খেলা শুরু করেছিলেন সেটির মূলে ছিলো মার্কিনিদের এক গভীর পরিকল্পনা যেটা বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়। এইক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ মনে করা যেতে পারে।

মার্কিনিদের এইভাবে থামিয়ে দেয়া কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে এই পর্যায়ের প্রতিরোধ ছিলো তাদের ভাবনায় অকল্পনীয়। কিন্তু এতে করেও কি আমেরিকার চিন্তায় বিএনপি প্রথম লেয়ারে রয়েছে?

না। নেই। বিএনপিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে না আনার পেছনে কয়েকটি অনুঘটক প্রধান বলে মনে হয়। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের প্রবল অবিশ্বাস ও আপত্তি, তারেক জিয়ার প্রতি উভয় দেশের অবিশ্বাস ও সন্দেহ। অন্যদিকে বি এন পিও যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল ফলে মার্কিন স্বার্থ সম্বলিত বিষয়াদি ব্ল্যাঙ্ক চেকের মত তারা করতে পারবে এটাও এতটা সরল নয়।

ফলে মার্কিনিরা সব কিছু ছাপিয়ে বর্তমান সরকারকেই যদি প্রেফার করে তাদের সমর্থনের জন্য আদর্শ, সেক্ষেত্রে; এই বিবেচনায় তাহলে এটিকে বিষ্ময়কর বলা যায়না। কেননা মার্কিন নীতি নির্ধারকরা অন্তত বাস্তবতা বোঝে এবং ভারত যতই বলুক কিংবা তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যতই হাঁক-ডাক দিক, এই অঞ্চলে আওয়ামীলীগই ভারতের জন্য কার্যকর বন্ধু, সেটা তারাও বোঝে।

তবে আমেরিকানরা সব কিছু ছাপিয়ে একটা পরিবর্তনের পক্ষেই থাকতে চাওয়ার প্রধান কারন হিসেবে যেটি মাথায় রাখবে বলে মনে হয় সেটি হচ্ছে—

বাংলাদেশে একটি স্থির রাজনৈতিক অবস্থা তথা একটি দলের বিকাশ ও তার ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠা মার্কিন নীতির জন্য হুমকি। সেটা তার আধিপত্য বিস্তারের গতিরোধক এবং একই দিকে তার নিও কলোনী তত্বের প্রেক্ষিতে পলিটিকাল সার্বভৌমত্বের প্রতিও হুমকির ব্যাপার।

আমেরিকা যে বিএনপিকে অপাংক্তেও অপশন বলে মনে করে, এটি বিএনপি’র নীতি নির্ধারণী মহল বোঝে ও জানে। বিএন পি নেতা ব্যারিস্টার শাহজান ওমর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে অবতার, ‘বাবা” ও ‘ভগবান’ বলে প্রকাশ্যেই উল্লেখ করেছেন।

মার্কিনিরা গত এক বছর ধরেই বিএনপিকে বলে আসছে তারা যদি বাংলাদেশে গণভ্যুথানের পরিবেশ তৈরী করতে পারে তাহলে তারা তাতে ফুয়েল যোগাতে সাহায্য করবে। অর্থ্যাৎ একটা মোমেন্টাম তৈরী করা।

মার্কিন স্পোকসপার্সন মিলারের ভাষায়, ‘আমেরিকা বাংলাদেশের জনগনের ইচ্ছের সাথে থাকবে’। এই বক্তব্যের নানা রকম মানেই হতে পারে। অর্থ্যাৎ মার্কিনিরা দেখতে চাইছে পলিটিকালি কারা মোমেন্টাম তৈরী করতে পারে।

সত্তরের দশকে মার্কিন গোয়ান্দাদের অন্য দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো চার্চ কমিশন। আয়রনি হচ্ছে সেই কমিশনের কার্যকলাপ চলাকালেই মার্কিনিরা খুন করে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে। সেই সময় কিসিঞ্জারও বলেছিল যে মুজিবের অবস্থা হবে আলেন্দের মতন। ক্রিস্টফার হিচিন্স তার উপরে উল্লেখিত গ্রন্থে লেখেন-

“Kissinger had received some very bad and even mocking press for his handling of the Bangladesh crisis, and it had somewhat spoiled his supposedly finest hour in China. He came to resent the Bangladeshis and their leader, and even compared (this according to his then aide Roger Morris) Mujib to Allende.”

ফলে এটা বলা যায় যে, হাজার চাপ থাকা সত্বেও মার্কিন নিরাপত্তা বলয় এই অঞ্চলে তাদের হেজিমনি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বদ্ধ পরিকর।

বিএনপি ক্রমাগতভাবে মার্কিন লবিং কোম্পানীগুলো দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে একটা চাপ তৈরী করতে চেয়েছে এবং করছে, ইউরোপে তারা প্রবলভাবে কাজ করছে আর দেশে আন্দোলনের হুমকি তো রয়েছেই।

পুরো বিষয়টি হচ্ছে, বিএনপি এমন অবস্থার তৈরী করলে মার্কিনিদের এই অঞ্চলে কথা বলবার প্রেক্ষাপট তৈরী হয় বিবাদ মিটিয়ে দেবার বড়ভাই হিসেবে নিজেকে হাজির করে। ফলে বিএনপির কার্যক্রম আর মার্কিনিদের কার্যক্রম একে অপরের পরিপূরক।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিএনপিকে এইভাবে লেবুর ছালের মত চিপে রস বের করে ব্যবহার করবার পরেও আমেরিকা তাকে এখনো অনেক পরের লেয়ারের অপশন হিসেবেই বিবেচনা করছে। অনুকুল পরিস্থিতি তৈরীতে ব্যবহার করছে।
গত ৩০ শে মে, বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রতিনিধিদের সাথে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন এম্বাসেডর পিটার হাসের যে বৈঠক হয় আমীর খসরু মাহমুদ সাহেবের বাসায় সেখানে বিএনপি তিনটি দাবী করে যার প্রতিটি দাবীতেই আমেরিকা সরাসরি ‘না’ বলে দেয়।

যার প্রথমটি ছিলো তারেক রহমানের ভিসা স্যাংশান প্রত্যাহার, দ্বিতীয়টি হচ্ছে সরকারী দলের বিভিন্ন নেতাদের ভিসা স্যাংশন প্রস্পেক্টিভ না করে সেটিকে ভূতপূর্ব বা রেট্রোস্পেক্টিভ করা এবং তত্বাবধায়ক সরকার দাবীকে সামনে আনা। আমেরিকা খুবই শক্তভাবে বিএনপিকে এই তিনটি ব্যাপারে না বলে ফিরিয়ে দেয়। এটা বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া নিশ্চিত সংবাদ।

এদিকে মির্জা ফখরুলের সাথে পিটার হাসের একটি গোপন বৈঠক হয়েছে ১২ অক্টোবর । যে বৈঠকের কথা পিটার হাস কিংবা মির্জা ফখরুল, কেউ স্বীকার করছেন না। কিন্তু বিস্বস্ত সোর্স থেকে জানা গেছে যে, পিটার হাস গত বৃহষ্পতিবার দুপুরে ফখরুলকে আমেরিকান ক্লাবে ডেকেছিলেন। ফখরুল অপ্রস্তুত অবস্থায় দ্রুত ক্লাবে গিয়ে পৌঁছেন। বৈঠকে পিটারের সাথে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাইস-কাউন্সেলর আরতুরো হাইন্স।

তত্বাবধায়ক সরকার দাবী ছাড়া ‘অন্য’ অপশন নিয়ে বিএনপি আলাপে রাজী আছে কিনা বা আওয়ামীলীগের সাথে সংলাপে বসার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে বাদ দিয়ে আলাপ চালানো যায় কিনা। এই সময়ে আমেরিকান প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষন দলের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ তোলেন হাইন্স।

একই সময়ে আর্তুরো ফখরুলের কাছে জানতে চান আদালত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেবার পর সেটিকে ফেরত আনার আইনী পদ্ধতি কি? উত্তরে মির্জা ফখরুল বলেন পার্লামেন্ট সেটা করতে পারে। ইলেকশনের দুই মাস আগে পার্লামেন্ট সেটা করতে পারে কিনা এই বিষয়ে জানতে চাইলে ফখরুল সদুত্তর দিতে পারেন নি।

বৈঠকে হাস ফখরুলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অনড় এবং ৮৬ সালের মডেলে এই নির্বাচন হতে পারে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে অনড় না থেকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সংলাপে বাসা যায় কিনা তা বিবেচনার জন্য বলেন পিটার হাস।

ফখরুল দলীয় ফোরামে আলাপ করে বিষযটি নিয়ে আরেকবার বসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এরপর ফখরুল সরকারের প্রাক নির্বাচনী বিষয় আর্তুরোর কাছে তুলে ধরে বিচার দেন।

যদিও মির্জা ফখরুলের এই একক মিটিংটি দলের অন্য নেতারা ভালোভাবে দেখেন নি। যেহেতু এটি ছিলো তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশনায় একটি অকষ্মাৎ আলোচনা ফলে বিএনপি’র নেতাদের করনীয় ছিলো সামান্য।

এই একই সময়ে বিএনপির অন্য নেতাদের সম্মানে ঢাকায় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেতো রেংগলি বারিধারায় তার বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করে যেখানে অংশ নেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির প্রধান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির সদস্য শ্যামা ওবায়েদ ও তাবিথ আউয়াল।

এই সমস্ত তৎপরতার একটা সরাসরি মেসেজ হচ্ছে, আমেরিকা বিএনপিকে কখনোই নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ অপশন বিবেচনা করেনি।

গত ২৮ শে জুন দৈনিক কালবেলা একটি সংবাদ প্রকাশ করে যেখানে মার্কিনিদের বরাতে বিএনপিকে দুইটি বিষয় বিবেচনায় আন্দোলন করতে বলেছে। (১) নির্বাচন বর্জন না করা (২) সহিংসতা না করা। দ্বিতীয় পরামর্শ দেখে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে বিএনপি প্রশ্নে মার্কিন ভাবনার চৌহদ্দী ভারতের সাথে একীভূত এবং এখানে অবিশ্বাসের একটা শক্ত স্থান রয়েছে।

লেখক: আইনজীবি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আমেরিকা কি বিএনপি-কে ক্ষমতায় বসাতে চায়? নিঝুম মজুমদার মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর