Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির সম্প্রীতির ও ঐতিহ্যের

রনি অধিকারী
১৭ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৩৯

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার সাথে মিশে আছে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আবহমানকাল ধরে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানা উপচার ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছে। দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, সামাজিক উৎসবও। দুর্গোৎসব উপলক্ষে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী একত্রিত হন, মিলিত হন আনন্দ-উৎসবে। তাই এ উৎসব সর্বজনীন। এ সর্বজনীন তা প্রমাণ করে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি দুর্গাপূজা দেশের জনগণের মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিজ্ঞাপন

ইতোমধ্যে কারিগররা প্রতিমা সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর পূজা কমিটিগুলো ব্যস্ত পূজার স্থান নির্ধারণসহ আনুষাঙ্গিক কাজে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জানান- পুজোর যাবতীয় উপকরণ, পুজো, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, চ-ীপাঠ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আরতী, আলোকসজ্জা বা, ডেকোরেশনসহ নানান প্রস্তুতি চলছে। পূজা আয়োজনকারী প্রতিটি কমিটি ও পারিবারিক পূজা উদ্যোক্তারা নান্দনিক ও সুন্দর আয়োজনের জন্য বিরামহীনভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে দেশব্যাপী চলছে আনন্দ-উৎসবের ঝর্ণাধারা। অশুভশক্তির বিনাশ ও শুভশক্তির অভ্যুদয় দুর্গা আরাধনার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত। যুগের বিবর্তনে দুর্গোৎসব বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। বাঙালি ঐতিহ্যগতভাবেই উৎসবপ্রিয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত। এখানে সব ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘেœ পালন করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছেন।

সত্য ও শুভর জয় -এই হচ্ছে সব ধর্মের মর্মকথা। অশুভ অসুরশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুভ দেবশক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের দিন হিসেবেই দুর্গাপূজার দশমীর দিনটিকে বলা হয় ‘বিজয়া দশমী’। অসুরকুলের দম্ভ-দৌরাত্ম্য থেকে দেবকুলকে রক্ষায় মাতৃরূপী ও শক্তিরূপী দেবী দুর্গার আগমন। অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা দেবকুলকে রক্ষা করেন। অন্যায় ও অশুভকে পরাস্ত করার মাধ্যমে ন্যায় এবং শুভবোধের প্রতিষ্ঠা ঘটে। দেবী দুর্গা সত্য, শুভ ও ন্যায়ের পক্ষের সংগ্রামে মর্ত্যরে মানুষকেও সাহসী করে তোলেন। দূর করে দেন যত গ্ল¬ানি, হিংসা-দ্বেষ, মনের দৈন্য ও কলুষ। যাবতীয় মহৎ গুণের প্রতি দেবী দুর্গা মানুষকে আকৃষ্ট করেন। ফলে সত্য, শুভ ও কল্যাণের এক গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে সর্বজনীন।

দুর্গাপূজা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ নানাভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যাবতীয় দুঃখ ভুলে গিয়ে, হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে প্রীতির মেলবন্ধন রচনার মাধ্যমে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাই দুর্গাপূজা হিন্দুসমাজে সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত। দেবী দুর্গা বিভিন্নরূপে এই মর্ত্যরে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন এবং আমাদের সার্বিক মঙ্গল নিশ্চিত করেন। তাই তিনি সর্বমঙ্গলা। আবার শিবের শক্তি বলেও তিনি শিবা। কারণ তিনি সব প্রার্থনা ও আরাধনা মঞ্জুর করেন এবং অসাধ্যকে সাধন করেন। এ জন্য তিনি শরণ্য, গৌরী। দুর্গা দশভুজ নামেও পূজিত ও আরোধিত হয়ে থাকেন।

দেশব্যাপী বইছে নির্মল সম্প্রীতি থেকে সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও কল্যাণময় অবস্থানের বিকাশ আরো বিস্তৃত ও বিকশিত হবে। উপরন্তু অশুভশক্তির পরাজয় ঘটিয়ে মঙ্গলদায়ক, শুভশক্তি ও ইতিবাচক চেতনার সম্প্রসারণ ঘটবে। অসুরের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। সেই থেকে বিজয় ঘটে শুভশক্তির। দেবীর আগমন ঘটে অন্যায়ের বিনাশ ঘটিয়ে, সজ্জনদের প্রতিপালনের অঙ্গীকার নিয়ে মানুষের মধ্যে নৈতিক আদর্শ জাগ্রত করার জন্য; মানুষের চিত্ত থেকে যাবতীয় দীনতা ও কলুষতা দূরীভূত করার জন্য। এ জন্য দুর্গোৎসব ধর্মীয় উৎসব হলেও তা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

শরতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বর্গলোক কৈলাস ছেড়ে মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। ছেলেমেয়েদের নিয়ে নির্দিষ্ট তিথি পর্যন্ত বাবার বাড়িতে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। দেবীর অবস্থানকালে পাঁচ দিন পৃথিবীতে ভক্তরা দেবী মায়ের বন্দনা করেন। এই বন্দনা কেন্দ্র করে দেশবাসী মেতে ওঠে উৎসব আনন্দে। ধর্ম মানুষে মানুষে প্রীতি, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ঐক্য ও শান্তির ডাক দিয়ে যায়। তার পরও অসুরের আকস্মিক উন্মত্ততা নষ্ট করে দেয় আবহমানকালের প্রীতিধন্য পারস্পরিক অবস্থানকে, ধ্বংস করে দেয় দীর্ঘকালীন হৃদ্যতাকে; সৃষ্টি হয় বৈষম্য, বিভেদ, হিংসা, অন্যায় ও অকল্যাণ। আর এ জন্যই মঙ্গলদাত্রী দেবী দুর্গার আগমন ঘটে কল্যাণ ও শান্তিকে সংস্থাপন করার জন্য এবং তা প্রতিবছরই। তিনি ন্যায়ের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে যান সবাইকে। সবাই তার এ ডাকের অপেক্ষায় থাকেন ব্যাকুল হয়ে একটি বছর। সবার আশা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœ থাকবে, দূর হয়ে যাবে সব সংকীর্ণতা ও বিভেদ। কারণ এ দেশের ঐতিহ্যই হলো মানুষে মানুষে সম্প্রীতি রক্ষার।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। তাই প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে এক মহামিলন ঘটে সবার। এবারের পূজাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে- আমরা এমনটিই দেখতে চাই। পূজাম-পের নিরাপত্তার ব্যাপারে যে ধরনের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবেও এর প্রতিফলন দেখতে চাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে নাগরিক দায়িত্বও কম নয়। এ ব্যাপারে সবাই আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন -এমনই দেখতে চায় দেশের মানুষজন। মানুষের শাশ্বত যাত্রা খণ্ড থেকে অখণ্ডের দিকে, অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে, বিচ্ছিন্নতা থেকে ঐক্যের দিকে। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনই তাদের সমগ্রের দিকে ধাবিত করে। পৃথিবীর সব ধর্মে মানবিক সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আধ্যাত্মিক দিক থেকেও আত্মিক শুচিতা ও বিশুদ্ধতা অর্জন এবং তা লালন করাই পরম লক্ষ্য। কিন্তু মানুষ কখনো কখনো সততা, বিশ্বাস ও ন্যায়নীতিতে অবিচল থাকতে পারে না। ক্রোধ-নিষ্ঠুরতা-জিঘাংসা বাসা বাঁধে মনে। এক অর্থে মহিষাসুর মানবমনের এই নেতিবাচকতা- যা মানুষকে নিয়ে যায় হিংসা, বিদ্বেষ আর কলুষতার পথে; তারই প্রতীক। দেবী দুর্গা তার শুভ আবির্ভাবে মানুষকে সেই পতন থেকে রক্ষা করেন।

অসুরবধে চক্র, গদা, তীর, ধনুক, খড়গ-কৃপাণ-ত্রিশূল হাতে মাতৃরূপেণ দেবী হেসে উঠেছেন। ধূপের ধোঁয়ায় সায়ংকালে ঢাক-ঢোলক-কাঁসর মন্দিরার চারদিক কাঁপানো নিনাদ আর পুরোহিতদের জলদকণ্ঠে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমঃ নমঃ’ মন্ত্র উচ্চারণের ভেতর দূর কৈলাস ছেড়ে দুর্গা পিতৃগৃহে আসেন। বিশুদ্ধ হিন্দু পঞ্জিকা মতে, ফল-শস্যপূর্ণা হবে বসুন্ধরা। ‘সুদর্শন’ পঞ্জিকা মতে, বিজয়া দশমীতে এয়োস্ত্রীদের দেবীবরণ ও সিঁদুর খেলার পর ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে দেবী ঘটকে বিদায় নেবেন। উৎসব-পার্বণ পালনের মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সৌহার্দের বন্ধন আরো দৃঢ় হোক। আমাদের মনের সব হিংসা, দ্বেষ, কালিমা দূর হয়ে যাক। সৌহার্দ-সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে সুখ ও সমৃদ্ধির পথে আমাদের দেশ এগিয়ে যাক – এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: কবি, সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

মত-দ্বিমত রনি অধিকারী শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির সম্প্রীতির ও ঐতিহ্যের

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কানপুরে প্রথম দিনে বৃষ্টির দাপট
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৫

সম্পর্কিত খবর