রাজনীতিতে মার্কিন দূতের শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ পরিত্যাজ্য
২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৫২
বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ আগে থেকেই সক্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বিভিন্ন ইস্যুতে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে যাচ্ছেন তিনি যা দেশের অভ্যন্তরে নানা বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। সকলের মনে প্রশ্ন উঠেছে এসবের মাধ্যমে কী হাসিল করতে চান বা কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান এই মার্কিন কূটনীতিক।
কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সম্প্রতি প্রায়ই আলোচনায় উঠে আসছেন তিনি। গত মাসে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের ওপর ভিসাবিষয়ক বিধিনিষেধ আরোপের হুমকি দিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন হাস। সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পিটার হাসকে ব্যাপক সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। যেসব কাজ তার করার কথা নয়, সেসবই করছেন তিনি। বিভিন্ন সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক কর্মীর মতো তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে তাকে। তার এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতর্ক উসকে দিচ্ছে।
এতসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে তাকে। বিশ্লেষকদের মতে, হীনমন্যতা থেকেই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের জনসমর্থনহীন ও জনবিচ্ছিন্ন বিশেষ একটি মহল। গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত জাতীয় যুব সম্মেলনে বক্তব্য দেন পিটার হাস। সেখানে তিনি প্রকাশ্যে বলেন যে দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতা না থাকা, আস্থার সংকট ও ভোট না দিতে পারার সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের তরুণরা রাজনীতিবিমুখ হচ্ছেন। এরপর রাজধানীর নর্থ সাউথ (এনএসইউ) ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আবারও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন পিটার হাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্টদূত পিটার হাসের এমন কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক একটি দেশে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। একটি বিশেষ মহল যেমন বিএনপি- জামাতের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের বিশেষ সুবিধার্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এমন অবৈধ হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে পিটার হাস।
জনবিচ্ছিন্ন এবং জনসমর্থনহীন সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপিকে রক্ষা করতে এবং অবৈধ উপায়ে তাদের ক্ষমতায় আসীন করতে অবতার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে একটি সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের বক্তব্য থেকে তার স্পষ্টতা পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে আরও বলতে হবে, বাবা তুই আমাদের বাঁচা।’ তার এই বক্তব্যই প্রমাণ করছে যে পিটার হাস এখন বিএনপির অবতার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি অবতার হয়ে বিএনপির পক্ষে কথা বলে তাদের উস্কে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে নিযুক্ত সকল রাষ্ট্রদূতের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে এদেশের জনগণ। রাষ্ট্রদূতদের এদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ও একপাক্ষিক কর্মকান্ড অশোভন, গর্হিত ও শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে বিবেচিত। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্দিষ্ট একটি দলের পক্ষ অবলম্বন করে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সে লক্ষ্যে নানা সময় বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। তার এই সকল কর্মকাণ্ড থেকেই প্রতীয়মান হওয়া যায় যে তিনি নতুন বিএনপির অবতার হিসেবেই এসেছেন।
আমরা দেখছি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির ওপর ভরসা করেই বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনের রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিজেদের ‘ভগবান’ বলে দাবি করে তার কাছে নিজেদের রক্ষার জন্য বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এই আবেদন এখন সর্বজনবিদিত।আর গণতন্ত্রের নামে বিএনপির চলমান জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন বিএনপির এই আন্দোলনকে উস্কে দিচ্ছে।
বিএনপির অবতার পিটার হাসের আচরণ সবসময়ই পক্ষপাতমূলক এবং একপেশে ছিল যা তিনি অনেক আগে থেকে করে আসছেন। গত বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিএনপির নিখোঁজ সাবেক এক নেতার বাসায় গিয়ে বিশেষ আলোচনা করেছেন। তিনি মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় অংশ নিলেও সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সহস্রাধিক গুম হওয়া সরকারি কর্মকর্তার স্বজনদের কথা কর্ণপাত করেননি। এমনকি ওই সকল জনহারা ব্যক্তিদের উদ্যোগে গঠিত ‘মায়ের কান্না’ নামের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দেওয়া স্মরকলিপিও গ্রহণ করেননি বিএনপির অবতার এই মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এ সময় পিটার হাসের আচরণ ছিল অদায়িত্বসূলভ, অপেশাদারী এবং অংশত অমানবিক, যা ভিয়েনা কনভেনশনের (১৯৬১) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর তথা বিএনপির স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসৌজন্যমূলক এবং পক্ষপাতমূলক আচরণের মাধ্যমে তার কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া সংবাদপত্রের মারফতে আমরা জানতে পারি যে, মায়ের কান্না নামের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কথা না শুনে ও তাদের স্মারকলিপি গ্রহণ না করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্থান ত্যাগ করেন, যা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দ্বৈত আচরণের বহিঃপ্রকাশ। তিনি মুখে মানবাধিকারের কথা বললেও আদতে তিনি মানবাধিকার হরণের পন্থায় হাঁটছেন। বাংলাদেশের জনগণ এমন কোন রাষ্ট্রদূতের কাছে এহেন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আশা করে না এবং কোনো রাষ্ট্রদূতের এমন আচরণ সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী এবং একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপস্বরূপ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের সচেতন জনগণ হতাশ হয়েছে। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরাও নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কথা বলছেন যা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত ও স্বাধীন দেশের জনগণের জন্য অসম্মানজনক। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের করা সকল কর্মকাণ্ড ও আচরণ সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। বিএনপির প্রতি তার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের অবৈধ হস্তক্ষেপরেই ইঙ্গিত বহন করছে। যা কোনভাবেই বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন দেশে গ্রহনযোগ্য নয়।
বাঙালি জাতি বিশ্ব ইতিহাসে একটি সাহসি জাতি, বীরের জাতি এবং বিজয়ী জাতি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি এমন হস্তক্ষেপ এবং তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ সম্পূর্ণভাবে বেআইনি এবং পরিত্যাজ্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে শুধরে নেওয়া। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের অবতার হিসেবে আবির্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের বিরোধিতা সত্ত্বেও সাহসী বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের রক্তে আমরা অর্জন করেছি আজকের এই সোনার বাংলা। শহীদের বুকের তাজা রক্তে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলার সাধারণ জনগণ অতীতে যেমন অন্যায়ের নিকট মাথা নত করেনি তেমনি ভবিষ্যতেও করবেনা। বিএনপির অবতার হিসেবে আবির্ভূত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উচিত বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সব ধরনের পক্ষপাতমূলক এবং একপেশে আচরণ ও কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করা। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো রাষ্ট্রদূত তথা বিদেশিদের কোনো অবৈধ হস্তক্ষেপকে এই বাংলার গণতন্ত্রকামী জনগণ মেনে নিবেনা। তাছাড়া জনসমর্থনহীন ও জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপির উচিত এই ধরনের বিদেশি প্রভু নির্ভর অপরাজনীতি বন্ধ করা। বিদেশি প্রভুদের ইন্ধনে পরিচালিত আন্দোলনের নামে সব ধরনের জ্বালাও-পোড়াও নীতি বন্ধ করা। তা নাহলে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশ থেকে ভবিষ্যতে বিএনপির অস্তিত্ব বিলীন হবে।
বাংলাদেশের মতো এমন একটি গণতান্ত্রিক দেশের মূল শক্তি এদেশের গণতন্ত্রমনস্ক জনগণ। এদেশ অতীতে পরিচালিত হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে জনগণের একান্ত ইচ্ছা ও সমর্থনে কোনো বিদেশি শক্তি তথা বিদেশি রাষ্ট্রদূতের ইশারায় নয়। এদেশীয় জনগণ যা চাইবে তাই হবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তথা বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূতের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশের কোনো পরিবর্তন অতীতে হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবেনা। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন দূত পিটার হাসের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটিলিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া রাজনীতিতে মার্কিন দূতের শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ পরিত্যাজ্য