নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া বিএনপির উপায় নেই
২৮ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৪৮
বছর খানেক ধরে চলে আসা জামায়াত-বিএনপি’র এক দফার অগণতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক দাবী জনগণের সমর্থন না পেয়ে স্তিমিত হয়েছে। এই বাংলাদেশ বিরোধী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের খুনি এবং পেট্রোল বোমা মেরে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে কোন আস্থা নেই তা আরও এক বার বাংলার মাটিতে প্রমাণ হয়েছে। আন্দোলনটা যতটুকু দানা বেঁধেছে তা ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াতে সুশীল দলের প্রতিনিধিদের উস্কানিতে। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেবে এমন খবর নিয়ে দেশে “অর্থনৈতিক ঝড়” আসছে বলে সর্বশেষ একটা আশার বেলুন ফুলিয়েছিলেন সাংবাদিক আবেদ খান। সে বেলুনেও নতুন কোন হাওয়া না পেয়ে চুপসে গেছে। আমেরিকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়ার অবস্থায় কি আছে? দিলেই বা কতটা দিতে পারবে। বিশ্ব রাজনীতির মাঠে চীন, রাশিয়া, ইউক্রেন, ইসরায়েল, হামাস নিয়ে তারাও প্যারায় আছে। দম ফেলবার সময় নেই। এর মধ্যে আবার নতুন ঝামেলা পাকিয়ে বাংলাদেশকে বিরোধী শিবিরে ঠেলে দিতে কে চায়?
বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম তিলকে তাল বানিয়ে, অসম্ভবকে সম্ভব ভাবতে শিখিয়ে, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হয়ে যাওয়ার গল্প দিয়ে, দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে রায় দিয়ে, সরকারকে, আওয়ামী লীগকে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেবার অলীক কল্পনার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে তাঁর নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করে বেশ কিছু দিন পার করলেন। আর কত? এত করেও পাওয়া যায়নি জনসমর্থন কিংবা ধাপ্পাবাজির জন্য নতুন কোন রসদ। দিন দিন রসদের উৎসগুলো শুকিয়ে এসেছে। নতুন কোন উৎসের সন্ধানও মিলছে না। অর্থনীতি নিয়ে আবোলতাবোল আর ধাপ্পাবাজি করার দিনও শেষ করে দিয়েছে আইএমএফ। ১৩ অক্টোবর মরক্কোর রাজধানী মারাক্কাসে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ বার্ষিক সভার সাইড লাইনে আয়োজন করা এক সংবাদ সম্মেলন আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা পরিচালক বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই আছে। অর্থনীতি নিয়ে মাঠ গরম করার অপপ্রচার করার সুযোগও তাদের আর থাকল না।
সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করে সেখানে ৪৩ লক্ষ মানুষ উপস্থিত করে সরকার পতনের মহাযাত্রা করবে বলে বাগাড়ম্বর করেছিল। সে সমাবেশের দিন জামায়াত-বিএনপি যৌথভাবে পুলিশ সদস্য পারভেজকে পিটিয়ে হত্যা করে, আওয়ামী লীগের কর্মীদের উপর আক্রমণ করে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করে, অডিট ভবন, পুলিশ হাসপাতালসহ অনেক স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে, মোটরসাইকেল, পিক-আপ, বাসে আগুন ধরিয়ে, কাকরাইল থেকে আরামবাগ নরক বানিয়ে মহাসমাবেশকে মহাশ্মশানে পরিণত করে নিজেরাই ধ্বংস করেছে। এতদিন যে অহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচীর মুখোশ এটে তারা চলছিল সে মুখোশ সন্ত্রাসের তাণ্ডবে ধুলায় মিশে গেছে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল, ৩ নভেম্বর এবং ১৫ ও ২১ আগস্টের খুনি জামায়াত-বিএনপি চক্রের সুস্থ রাজনীতি করার কোন নৈতিক অধিকার কখনোই ছিল না, এখনো নেই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের এই অপশক্তি পোষ্যদের আস্কারা দিয়ে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। ২৮ অক্টোবরের তাণ্ডবের পর সে সুযোগ আর পশ্চিমাদেরও থাকবে না।
জামায়াত-বিএনপি’র প্রধান সহযোগী সংগঠন, তথাকিথিত সুশীল সমাজও এখন আর তাদের প্রধান দাবী, সরকার প্রধানের পদত্যাগ কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আর কথা বলেন না। সুশীলেরা অনেক আগে থেকেই পরিস্থিতি বুঝে এসব দাবীর বিষয়ে চুপ করে আছেন। এখন তারা দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কথা বলছেন। যে সকল কূটনীতিকেরা এতদিন মানবাধিকার, গণতন্ত্র ফেরী করে তাদের এদেশীয় সাগরেদদের আন্দোলনের পালে হাওয়া দিয়েছেন তারাও এখন চুপ হয়ে গেছেন। এই কূটনীতিকদের বর্তমান প্রচেষ্টা হচ্ছে সংলাপের জন্য দুই পক্ষকে রাজী করানো। তাদের উদ্দেশ্য, সংলাপ সংলাপ খেলার মধ্যে যদি জামায়াত-বিএনপি’র পক্ষে কিছু ঝোল টেনে নেওয়া যায়। সংলাপ টোপ গেলার দল আওয়ামী লীগ নয়। জামায়াত-বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী, খুনি ও সন্ত্রাসী নেক্সাসকে কোন রকম রাজনৈতিক ছাড় দেয়ার সুযোগ তাদের নেই। তাদের সামনে এখন দুটো পথ খোলা। এক) তাদের ঘোষিত নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য সন্ত্রাসী পথ নেওয়া; অথবা দুই) আন্দোলন বন্ধ করে সুবোধ বালকের মত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা।
সংলাপে বসার জন্য আসলে জামায়াত-বিএনপি মুখিয়ে আছে। মুখে তাঁরা এখন আর সংলাপের বিরোধিতা করছেন না। শর্ত দিচ্ছেন শুধু। তার মানে, আরেক বার সাধিলেই খাইব। এছাড়া তাদের আর কিছু করারও নেই। যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন তাঁরা জানেন যে তাদের ছাড়াই নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচন ঠেকানো তাদের কম্ম নয়। অতীতে নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে তাঁরা আম ও ছালা দুইই খুইয়েছেন। নেট লস হচ্ছে পাঁচ শতাধিক হত্যা, কয়েকশ স্কুল-কলেজ, যানবাহন, বাড়িঘর, অফিস-আদালত, জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার দায় কাঁধে নিয়ে চলা। ১৩ সালে বিএনপি’র জামায়াত-শিবির এবং তাদের সৃষ্ট শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের ভাইয়েরা আগ্নেয়াস্ত্র, রকেট লঞ্চার, পেট্রোল বোমা নিয়ে শক্তিশালী ছিল, এখন তাও নেই। নির্বাচনে বাঁধা দেয়ার মুরোদ তাদের এখন নেই। এমন পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন করতে না পারে; কয়েকটি হলেও আসন নিয়ে যদি সংসদে বসতে না পারে তবে তাদের মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করে নিতে হবে।
লন্ডনে জামায়াত পরিবেষ্টিত এবং জামায়াতী রাজনৈতিক দর্শন প্রভাবিত বিএনপি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানের বুদ্ধিতে ১৩ সালের নির্বাচন বয়কট না করে যদি বিএনপি জামায়াত আর খুনি জিয়া পরিবার বাদ দিয়ে তাদের সিনিয়র কোন নেতার নেতৃত্বে বিএনপি নাম বদল করে নেতা-কর্মিদের নিয়ে নতুন একটা দল খুলে নির্বাচনে অংশ নিতেন তবে এতদিনে সে দলটি দাঁড়িয়ে যেত। আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটা মধ্য ডানপন্থী দল হিসেবে বেশ শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিতে পারত। তাতে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হত। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকত। প্রতিযোগিতা বিকাশ ঘটায়। দেশের রাজনীতি সুস্থ হয়ে উঠতে পারত। আমরা একটা ভাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে পারতাম। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত এবং খুনি ও দুর্নীতিবাজ জিয়া পরিবারকে বাদ দিয়ে সন্ত্রাস মুক্ত পরিবেশে সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রকৃত রাজনীতি করার সুযোগ এখনো আছে। তৃণমূল বিএনপি সে সুযোগটাই নিতে চাচ্ছে। কতটা পারবে তা নির্ভর করবে তাদের নেতৃত্বের যোগ্যতার উপর। তৃণমূল বিএনপি না পারলে অন্য কেউ সুস্থ রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে মধ্য ডানপন্থার ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করে ফেলবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সংসদ নয়, মুসলিম লীগের পরিণতিই হবে বিএনপির ঠিকানা।
আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। বিএনপি নির্বাচনে না এলে তৃণমূল বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ১৪ দল ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো, আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্যদের নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জামায়াত-বিএনপি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। তাদের কিছু বলার বা করার থাকবে না। আজকের দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পতিত হওয়া বিএনপি’র জন্য স্বল্প কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে কল্যাণকর হবে না। বিগত বছর খানেক সময় ধরে আন্দোলন আন্দোলন খেলার মাধ্যমে বিএনপি’র নেতা কর্মীরা সংগঠিত হয়েছে, উদ্দীপ্ত হয়েছে। এদের সংগঠন এবং উদ্দীপনা ধরে রাখার জন্যে হলেও বিএনপি’র নির্বাচনে অংশ নিয়ে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসবে বলে ধারণা করি।
যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয়। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে এদের নেতা-কর্মিরা বিএনপি’র ছত্রছায়ায়, বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একাত্তরের ঘাতক, সাম্প্রদায়িক এবং জঙ্গিবাদী অপশক্তিকে কোন ভাবেই নির্বাচনে এবং রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। আইন করে এদের অন্য দলের ব্যানারে নির্বাচনে এবং রাজনীতির মাঠে নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াত নিষিদ্ধ এবং মূলধারার রাজনীতি থেকে খুনি ও দুর্নীতিবাজ জিয়া পরিবার বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি সুস্থ এবং সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে না।
লেখক: চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, নিবন্ধ লেখক এবং টেলিভিশন টকশো আলোচক
সারাবাংলা/আইই