লেনদেন বিল ’২৩: সামনে এগোনোর আরেকটি ধাপ
৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৫
প্রাচীনকালের ইতিহাসে এমনও কাহিনী আছে পাশা খেলে হেরে নিজের স্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছেন কোন রাজা বাদশাহ। সেইসব দিন তো এখন কালের সাক্ষী। কিন্তু সম্পদের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ একটি প্রাচীন পদ্ধতি। মানুষ তার মূল্যবান যা কিছু তা বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী।
বন্ধক রাখার সুবিধা হলো পরবর্তীতে আর্থিক অবস্থা ভালো হলে বন্ধকীকৃত সম্পদ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিক্রি করলে সম্পদের মালিকানা চলে যায়। বন্ধক রাখলে মালিকানা সম্পূর্ণ যায় না বরং যার কাছে বন্ধক রাখা হচ্ছে তার সাথে যৌথ মালিকানা তৈরী হয়। এ বিষয়টা মাথায় রেখেই অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখেও যেন ঋণ মেলে সে লক্ষ্যে ‘সুরক্ষিত লেনদেন (অস্থাবর সম্পত্তি) বিল ২০২৩’ বিলটি জাতীয় সংসদে পাস হয়।
ইতিপূর্বে বাংলাদেশে জামানত হিসেবে জমি, বাড়ি বা বাড়ির মতো স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখা যেত। নতুন এই আইনের ফলে অস্থাবর সম্পত্তি যেমন সোনা, রুপা, গাড়ি, আসবাবপত্র ইত্যাদিও বন্ধক রাখা যাবে।
উক্ত আইনে যেসব সম্পদকে অস্থাবর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে –
১. ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত স্থায়ী আমানতের সনদ
২. সোনা, রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু; এগুলোর ওজন, কত ক্যারেট ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেমন গহনার দোকান থেকে সনদ দ্বারা যাচাই করা থাকতে হবে
৩. নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ার সার্টিফিকেট
৪. মেধাস্বত্ব অধিকার দ্বারা স্বীকৃত মেধাস্বত্ব পণ্য
৫. সফটওয়্যার বা অ্যাপস যার মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব
৬. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে রেজিস্ট্রেশন করা যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক যানবাহন
৭. নিয়ম মেনে সংরক্ষণ করা কৃষিজাত পণ্য
৮. প্রক্রিয়াজাত মৎস্য বা জলজপ্রাণী
৯. বন্য প্রাণী, আয়বর্ধক জীবজন্তু
১০. বিধিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক বছরের অধিক মেয়াদি কোন ইজারা
১১. সড়ক পরিবহন আইন দ্বারা রেজিস্ট্রিকৃত কোন মোটরযান
এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২৩ এর মে মাসে মন্ত্রিসভায় এ আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন মে মাসে বলেন অস্থাবর সম্পত্তির আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য এ আইনটি করা হচ্ছে। তবে অস্থাবর সম্পত্তিগুলো রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আইসিটি ব্যবসায়ী, যাদের অ্যাপ আছে, মেধাস্বত্ব আছে তারা সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে বাজার দর মূল্যায়ন পূর্বক সেই মূল্যের বিপরীতে ঋণ নিতে পারবেন।
এ বিল প্রাথমিক থেকে চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে চার বছর ধরে যিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি জনাবা সোহেলি আফরিন ২৬ অক্টোবর ফেসবুকে নিজের টাইম লাইনে তুলে ধরেন এ যাত্রার কথা_
জনাবা সোহেলি লিখেন- ‘‘২০১৯ সালে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ডিপার্টমেন্টে যোগ দেওয়ার পর আমাদের তৎকালীন মহাব্যাবস্থাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম স্যার movable collateral নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দেন। এই দীর্ঘ চার বছরে দুইজন গভর্নর স্যার, তিনজন ডিজি স্যার, বেশ কয়েকজন ইডি স্যার ও ডিরেক্টর স্যারদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করেছি। অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করার সফলতা এলো গতকাল মহান জাতীয় সংসদে ‘সুরক্ষিত লেনদেন (অস্থাবর সম্পত্তি) বিল, ২০২৩’ পাশের মাধ্যমে। এই মুহূর্তটিতে মহান জাতীয় সংসদে উপস্থিত থাকতে পারাটা আমার একটি বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার সম্মানিত সিনিয়রগণ, বিশেষ করে নির্বাহী পরিচালক মো. আবুল বশর স্যারকে ধন্যবাদ এবং আমার টিমকে অভিনন্দন।”
তিনি মন্তব্যের ঘরে এ বিলের একটি চুম্বক অংশ তুলে ধরেন এভাবে- ‘আইনটি মূলত জামানত হিসেবে ব্যবহারযোগ্য অস্থাবর সম্পত্তি নিবন্ধন করার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এর ফলে যেসব মানুষের জামানত রাখার মতো কোন স্থাবর সম্পত্তি নেই, তারা অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে এবং জামানতটি রেজিস্ট্রিকৃত থাকায় ঋণদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও সুরক্ষা পাবে। অস্থাবর সম্পত্তি ঋণগ্রহীতার দখলে থাকবে কি না ঋণ সুবিধা গ্রহণের সময় তা নির্ভর করবে সম্পত্তির ধরনের উপর। আইন প্রণয়ন প্রাথমিক ধাপ। অবকাঠামোগত যেসব কাজ তা এখন শুরু করা যাবে। এ আইন ব্যাংক,বীমা,আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা যারা ঋণ প্রদানের কার্যক্রমের সাথে জড়িত তারা সকলেই এ আইনের সুবিধা নিতে পারবে।’
বিলটি যখন প্রাথমিকভাবে সংসদে উপস্থাপন করা হয় তখন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘স্থাবর সম্পত্তি জামানত রেখে ঋণ নেয়া হয়, এখানে ব্যাংকগুলো লুটপাটের আখড়া হয়ে উঠেছে। বিলটি ভালো। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জন্য এ আইন প্রয়োজন। কিন্তু এটি বিপর্যয় ডেকে আনবে। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে সেটা প্রশ্ন।’
দেশের অধিকাংশ মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এবং তারা উচ্চ সুদে অল্প টাকা ঋণ করে সুদের চক্রে আটকে যান। ভীষণ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আপনার কাছে থাকা গহনা বন্ধক রেখে ঋণ নেয়া আপনার জন্য নিশ্চয়ই সুবিধার হবে?
একটি আইন যখন প্রণীত হয়, সে আইন সুষ্ঠুভাবে কার্যকর হয় তার সুফল সবাই ভোগ করে- সরকার কর্তৃক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হলে তথ্য বাতায়নে জামানতযোগ্য অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণী ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন হলে সেই তথ্যভান্ডার সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরই কাজে লাগবে। আমাদের মনে রাখতে হবে নিয়ম কানুন মেনে ঋণপ্রাপ্তি সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অধিকার। এ বিল সেই অধিকার প্রাপ্তি আরেকটু সহজ করবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অর্পিতা চৌধুরী মত-দ্বিমত লেনদেন বিল ’২৩: সামনে এগোনোর আরেকটি ধাপ