Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহীদ নূর হোসেন: চেতনাদীপ্ত জীবন্ত পোস্টার

মানিক লাল ঘোষ
১০ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:০০

গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ ১০ নভেম্বর। আর এইদিনের রাজনৈতিক হিরো সাহসী যোদ্ধা শহীদ নূর হোসেন। গণতন্ত্র মুক্তি পাক-স্বৈরাচার নিপাত যাক বুকে-পিঠে ধারণ করে অমিত তেজ আর বুকভরা সাহস নিয়ে মিছিলে নেমে এক যুবক ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকের রক্তে ঢাকার পিচঢালা কালো রাজপথকে করেছিল রক্তে রঞ্জিত। সে আমাদের ’৫২ ’৬৯ ’৭১ এর সাহসী দেশপ্রেমিকদের গর্বিত উত্তরসূরি, আমাদের সংগ্রামী চেতনার আরেক নাম। সেদিন স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল গণতন্ত্র রক্ষার এই সাহসী বীরকে। তার এই সাহসী আত্মত্যাগ আমাদেরকে আন্দোলিত করে, চেতনাকে জাগ্রত করে প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে। শহিদ নূর হোসেন আজ একটি আন্দোলনের মাইলফলক। গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গকারী নূর হোসেনের সাহসী আত্মদানকে আমার সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি।

বিজ্ঞাপন

১০ নভেম্বর এলেই রাজপথে যাদের ঠিকানা তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় শহিদ নূর হোসেন, তারা বার বার ফিরে যায় ১৯৮৭ সালে। বিশেষ করে তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যারা জড়িত ছিলো।

মূলত ১৯৮১ সালে প্রতিকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে আসার পর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বৈরশাসকের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। সেই লক্ষ্যে তার নেতৃত্বে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। স্বৈরাচার বিরোধী সেই গনতান্ত্রিক আন্দোলন – সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচির
অংশ হিসেবে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর— ১৫ দল, ৭ দল ও ৫ দলের সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি ছিলো। সেই কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর সমর্থনে অবস্থান ধর্মঘট ঘেরাও কর্মসূচিতে রূপ লাভ করেছিল। স্বৈরশাসকের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে ১০ নভেম্বর সকাল থেকেই সচিবালয়ের চারদিকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মিছিল সমবেত হয়। তখন তোপখানা রোডের মুখে পুলিশ বক্স পেরিয়ে শুরু হয় যুবলীগ কর্মী নূর হোসেনের সাহসী মিছিল।

এ দিনে হাজারো প্রতিবাদী যুবকের সঙ্গে জীবন্ত পোস্টার হয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন। তার বুকে-পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এই জ্বলন্ত স্লোগান।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অকুতোভয় সেই যুবকের অগ্নিঝরা স্লোগান সহ্য হয়নি তৎকালীন স্বৈরশাসকের। স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় গনতান্ত্রিক আন্দোলনের এই সাহসী যুবকের বুক।

বিজ্ঞাপন

নূর হোসেনেরর জন্ম ১৯৬১ সালে। পৈতৃক বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তার পরিবার স্থান পরিবর্তন করে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে আসে। বাবা মুজিবুর রহমান ছিলেন পেশায় আটোরিকশাচালক। তার মায়ের নাম মরিয়ম বিবি। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর নূর হোসেন পড়াশোনা বন্ধ করে মোটরচালক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। এর পাশাপাশি অংশ নিতেন যুবলীগের মিছিল সমাবেশে।

স্বৈরাচার বিরোধী ১০ নভেম্বর সেই অগ্নি ঝরা কর্মসূচিতে যোগ দিতে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী, তিন দলীয় জোটের নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার গাড়ী পৌঁছামাত্র দৌঁড়ে এসে নূর হোসেন নেত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করে তার দোয়া নিয়েছিলেন। সেখান থেকে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নূর হোসেন শহীদ হন। উপস্থিত সবার ধারণা শেখ হাসিনার প্রাণ নাশের জন্য তার গাড়ীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল। সেই গুলিতেই নুরহোসেন শহীদ হন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার গতিপথ থামিয়ে দিতে শুরু হয় পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ। আন্দোলনকারীদের সাথে ছাত্রনেতাদের শুরু হয় সংঘর্ষ। পল্টন তখন রণক্ষেত্র। এই সময়টাতে পুলিশের গুলিবর্ষণে শহিদ হয়েছেন নূর হোসেন। আহত হম অসংখ্য।

নূর হোসেনের আত্মদানের মাধ্যমে সেদিন গণতন্ত্রের নতুন সংগ্রাম শুরু হলো। শুরু হলো নূর হোসেনের বুকে পিঠে লেখা সেই স্লোগান নিয়ে আন্দোলনের নতুন যাত্রা। নূর হোসেন উদ্বুদ্ধ করল লাখ লাখ ছাত্র-যুবকদের। সেই সংগ্রামের ধারায় ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তিন দশকের ও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও মূল্যায়ন হয়নি নূর হোসেনের আত্মদানের। আজও পূরণ হয়নি নূর হোসেন স্বপ্ন, সেদিন নূর হোসেনরা স্বপ্ন দেখেছিলো স্বৈরাচারের ধ্বংসস্তুপের ওপর গণতন্ত্রের পতাকা, কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন আজও স্বপ্নই থেকে গেল।

গণতন্ত্রর রক্ষার আবেদন নিয়ে ১০ নভেম্বর প্রতিবছর পালিত হয় শহিদ নূর হোসেন দিবস। তাই নূর হোসেন আত্মার প্রতি শুদ্ধা জানাতে হলে শুধু টিভি বা মিডিয়া কভারেজ নয়, বাস্তবিক অর্থে দুর্নীতিমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্রের শত্রু, তথা দুর্নীতিবাজ কালোটাকার মালিক, কালো আইন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যারা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংসতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণতন্ত্র সংকটমুক্ত হোক, নূর হোসেনের আত্মা শান্তি পাক-এটাই আমাদের কামনা।

লেখক: ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-এর সহ সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য

সারাবাংলা/এসবিডিই

মত-দ্বিমত মানিক লাল ঘোষ শহীদ নূর হোসেন: চেতনাদীপ্ত জীবন্ত পোস্টার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর