মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা
১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১০
মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের বেশ কয়েকটি শহরে সেনাবাহিনীর সাথে জাতিগত সশস্ত্রগুষ্টির প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) এই তিনটি দল মিলে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করে। গত ২৬ অক্টোবর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স চীন – মিয়ানমার সীমান্তে উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের এক ডজন সামরিক চৌকিতে সমন্বিত হামলা চালিয়ে সীমান্ত শহর চিন শওয়ে হাউ দখল করে নেয়। এই সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী চীনের সাথে বাণিজ্যের জন্য একটি প্রধান সীমান্ত ক্রসিং পয়েন্ট সহ উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের তিনটি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায়। জোটটি তাদের এলাকা সম্প্রসারন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে এবং অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম জব্দ করে আরও সামরিক চৌকির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। জোটের সদস্যরা জানায় যে, অপারেশন ১০২৭ নামের এই অপারেশনটি মিয়ানমারের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাদের অঞ্চলকে শক্তিশালী ও রক্ষা করা, নিপীড়নমূলক সামরিক স্বৈরশাসন নির্মূল করার পাশাপাশি সাইবার স্ক্যামিংয়ের ক্রমবর্ধমান ব্যবসার অবসান ঘটাতে পরিচালিত হচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের পূর্ব সীমান্তের স্বায়ত্তশাসিত সামরিক অঞ্চলে সাইবার স্ক্যামিং শিল্পের উত্থান ঘটেছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ এই কাজে জড়িত।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখলের পর এই আক্রমণ জান্তা সরকারে বিরুদ্ধে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ছিল বলে জানা যায়। এই জোট চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং চীন- মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলের কাছে তাদের ঘাঁটিগুলোর অবস্থান। মিয়ানমারে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক দাবি, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং জাতিগত-জাতীয়তাবাদী মনোভাব নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। দলগুলো একত্রিত হয়ে এবং অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে না পারায় তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ও সফলতা লাভ করতে পারে নাই। অপারেশন ১০২৭ এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নজিরবিহীন পর্যায়ের সমন্বয়ের ইঙ্গিত দেয় এবং এটি প্রতিরোধ বাহিনীর শক্তিকে গতিময়তা দিয়ে নতুন স্তরে নিয়ে এসেছে। এই অপারেশন মিয়ানমারের জনগণ এবং সামরিক শাসনের বিপক্ষের জনগণের কাছে আশা জাগিয়েছে যে এই বিপ্লবে বিরোধীদের জয় হবে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোরালোভাবে অংশ নিচ্ছে, যা ক্ষমতার ভারসাম্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে এর ফলে বিপ্লবের শক্তি বাড়ছে। জোটটি এ পর্যন্ত ৮০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে এবং চিন শওয়ে হাউয়ের সীমান্ত পোস্ট দখল করেছে। ১০০ জনেরও বেশি সামরিক সৈন্য প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করেছে।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং, জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর এই জোটের বড় ধরনের অভিযানের সক্ষমতা এই অঞ্চলের লাভজনক মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা থেকে অর্থায়নের কারনে সম্ভব হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে মিন অং হ্লাইং জানায় যে শান রাজ্যে চলমান সমস্যাটি মাদকের অর্থায়নের কারণে শুরু হয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে মাদক থেকে অর্জিত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ আনা হয়, তবে তাঁরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক মাদক উৎপাদন ও পাচার চলছে, যার মধ্যে আফিম ও হেরোইন এবং মেথামফেটামিন অন্যতম। বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে তাদের সশস্ত্র আন্দোলনে অর্থায়নের জন্য এই মাদক ব্যবসাকে দায়ী করা হয়। তবে তাদের পাশাপাশি এই কাজে আঞ্চলিক পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এই মাদকের কারনে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংগঠিত হচ্ছে যা ক্যাম্পগুলোকে অশান্ত করে জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকির সৃষ্টি করছে।
মিন অং হ্লাইং মন্ত্রিসভাকে জানিয়েছেন যে, সামরিক বাহিনী সামরিক শিবিরগুলিতে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করবে। স্থলভাগের সংঘর্ষে ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে মিয়ানমার জান্তা বিরোধীদের লক্ষ্য করে বিধ্বংসী বিমান হামলার পরিকল্পনা করছে। বিমান হামলা হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে এবং মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। মিয়ানমারের সামরিক শাসক ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোটের মধ্যে তীব্র সংঘাতের কারণে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) শুক্রবার এক আপডেটে বলেছে, ৯ নভেম্বর পর্যন্ত উত্তর শানের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে। ওসিএইচএ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের শুরু থেকে প্রতিবেশী সাগাইং অঞ্চল এবং কাচিন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষে আরও ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
৪ নভেম্বর, কাচিন রাজ্যের লাইজায় অবস্থিত কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সদর দপ্তর লক্ষ্য করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া একটি আর্টিলারি রাউন্ড চীনের অভ্যন্তরে আঘাত হানে, এতে এক চীনা নাগরিক নিহত ও আরও তিনজন আহত হয়। ২৭ অক্টোবর চীনা সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলে পরিচালিত অপারেশন ১০২৭ এর বিস্ময়কর সাফল্যের পর সংঘাতের তীব্রতা ও সাফল্য নতুন মাত্রা লাভ করে। সামরিক ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠীগুলো আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ১০০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটিসহ অনেক সীমান্ত শহরও দখল করে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনা প্রধান দেশে প্রতিরোধ আক্রমণ ঠেকাতে দেশের রিজার্ভ সেনাদেরকে সম্মুখসারির যুদ্ধে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সব সহায়ক বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই অনেককে পদাতিক ব্যাটালিয়নে পাঠানো হয়েছে। চীন, সীমান্ত এলাকায় অপরাধ দমনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর চাপ প্রয়োগ করছে এবং সহিংসতা বৃদ্ধির উদ্বেগের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পরে চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রী ওয়াং জিয়াও হং মিয়ানমার সফর করেছে।
চীন ও মিয়ানমারের মধ্যকার একটি কৌশলগত বাণিজ্যিক ফাঁড়ি জান্তাবিরোধী যোদ্ধারা দখলে নেওয়ার পর চীন, সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের কারনে চীনা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এই অঞ্চলে পাইপলাইন রয়েছে যা চীনে তেল ও গ্যাস পরিবহন করে এবং সেখানে চীনের বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগের আওতাধীন শত কোটি ডলারের একটি রেলওয়ে প্রকল্প রয়েছে। সংঘর্ষের কারনে বাণিজ্য কেন্দ্র মিউজে ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ বন্ধ রয়েছে এবং সীমান্ত বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
চীন, মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ক্রমবর্ধমান লড়াই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নং রং মিয়ানমারে সফর করে জান্তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং মিয়ানমারকে তাদের অভিন্ন সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহযোগিতা করার আহ্বান জানায়। তিনি জান্তাকে আন্তরিকভাবে চীনা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং মিয়ানমারে চীনা কর্মী, প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের নিরাপত্তা জোরদারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। চীন মিয়ানমারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বালানি অবকাঠামোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চলমান রেখেছে। মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চীন মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সাথে কূটনৈতিকভাবে জড়িত রয়েছে এবং মিয়ানমারে বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী হিসাবেও কাজ করছে। চীন মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব পক্ষকে লড়াই বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
৭ নভেম্বর এক বিবৃতিতে জোট জানিয়েছে যে, তাদের স্থল অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং তারা আরও কয়েকটি সামরিক স্থাপনা দখলের পাশাপাশি সেখানকার সামরিক অস্ত্রশস্ত্রও দখলে নিয়েছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণতান্ত্রিক সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর এ হামলাকে সামরিক বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তারা বেসামরিক নাগরিকেদের সমন্বয়ে গঠিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সকে (পি ডি এফ) সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতা করছে বলেও জানা গেছে। সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে প্রায় তিন বছর ধরে চলমান সংঘর্ষে প্রায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখন দুর্বল অবস্থায় চলে এসেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট মিন্ট সুই সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চলমান অর্জন দেশটি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। এই আক্রমণ বেসামরিক পিডিএফ’কেও উজ্জীবিত করেছে। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মিন্ট সুই বলেন যে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে, সরকার যদি সীমান্ত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে দেশটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে যাবে।
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারনে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। দশকের পর দশক ধরে এই অঞ্চলে চলমান সংঘাতের কারনে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও অপার সম্ভাবনা থাকার পরও এই অঞ্চল অনুন্নত রয়ে গেছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারনে সন্ত্রাসীগুষ্টি এই এলাকায় তাদের তৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে এবং মাদক পাচার ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি করে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করছে। চলমান সংঘাত বন্ধ হলে এই অঞ্চলে বাণিজ্য, পর্যটন ও যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের ফলে সমৃদ্ধি আসবে। তাই দ্রুত এই সংঘাত নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ মিয়ানমার আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন মত-দ্বিমত মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা