পর্যটন নগরীতে রেল: উঁকি দিচ্ছে সোনালী ভবিষ্যৎ
১১ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৫৫
সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারে রেল আসবে— স্থানীয় মানুষ সে গল্প শুনেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অবশেষে ৫ নভেম্বর ট্রায়াল ট্রেন যখন প্রথমবারের মতো দোহাজারী স্টেশন পেরিয়ে কক্সবাজারের দিকে গেল তখন স্থানীয় মানুষ দেখলো সত্যি রেল এসেছে তাদের কাছে।
১১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন থেকে ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ এই রেলপথের উদ্বোধন করেন এবং উদ্বোধনী ট্রেনে চড়ে যান রামু পর্যন্ত। এই শুভ যাত্রার মধ্য দিয়ে একটি স্বপ্ন সত্যি হতে দেখলো স্হানীয় মানুষ। দেখলো কথা দিয়ে কথা রেখেছেন মুজিবের মেয়ে।
কক্সবাজারকে ট্রেন নেটওয়ার্কে যুক্ত করার ভাবনা ছিল ব্রিটিশদের, ১৮৯০ সালে। ১৩৩ বছর পর সেই ভাবনার বাস্তবায়ন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। রেলপথ দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে পৌঁছেছে অনেক আগেই। এখন সর্ব দক্ষিণের কক্সবাজারও যুক্ত হলো রেল নেটওয়ার্কে। সরকার দেশের সব জেলাতেই পৌঁছাতে চায় রেল। নতুন এই পথের মাধ্যমে দেশের ৪৮টি জেলায় পৌঁছে গেল রেল।
একসময় খুলনা, যশোর, পঞ্চগড় কিংবা সিলেট অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত ছিলো সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য। সেসব এখন অতীতের ইতিহাস হতে চলেছে।
এখন চাইলেই ঝিক ঝিক শব্দ আর মৃদু দোলায় দুলতে দুলতে রেললাইনের দু’পাশের বন-পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে স্বল্প খরচে, আরামে, নিরাপদে ও দ্রুত সময়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে কক্সবাজার। ভাড়া থাকবে সহনীয় পর্যায়েই। ঢাকা-কক্সবাজার পথে ট্রেনের জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ১৮৮ টাকা। আর সর্বোচ্চ এসি বার্থে ১৭২৫ টাকা ঠিক করা হয়েছে।
১০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ
বিনিয়োগ সংকট, ভূমি অধিগ্রহণ, ভৌগলিক প্রতিকূলতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো বড় বড় বাধা পেরিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে কক্সবাজার রেলপথ। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী থেকে কক্সবাজার সদর পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ১০০ কিলোমিটার (কাজ হয়েছে ১০৩ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার) নতুন রেললাইন। খরচ হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ২টি ও চীনের ২টি কোম্পানী মিলে তৈরি করেছে এই রেলপথ।
রেলপথ তৈরিতে ৩৯টি সেতু, ২৫১টি কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেনির ১৪৪টি লেভেলক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। লেভেল ক্রসিংয়ের ৪০ শতাংশই আন্ডারপাস, যা দেশের রেলপথের ইতিহাসে প্রথম।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন করে আটটি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। দোহাজারীতে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত স্টেশন আগেই ছিল। এর পরবর্তী স্টেশনগুলো হচ্ছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও সর্বশেষ কক্সবাজার।এসব রেলস্টেশনে রয়েছে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগনাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম।
কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে চুনতি, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক। প্রকল্পের প্রয়োজনে নতুন গাছ রোপণ, বণ্যপ্রাণীর নিরাপত্তার জন্য একাধিক বিকল্প রেখে রেলপথটির নকশা প্রণয়ন করা হয়।
এশিয়ান হাতির নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য বিভিন্ন স্থানে একাধিক আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, কৃত্রিম জলাধার তৈরী করা হয়েছে। নতুন করে ৪১ প্রজাতির সাত লাখ গাছ লাগানো হয়েছে।
এ রেলপথে ট্রেন চলাচলে ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হবে সেন্সরযুক্ত ডিভাইস। ফলে হাতি বা বন্যপ্রাণী রেললাইনে উঠে গেলে সর্বোচ্চ এক কিলোমিটার দূর থেকে চালক বুঝতে পারবেন।
নতুন এই রেলপথে ট্রেনযাত্রা অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কেননা, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছরই বিপুলসংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে আসেন। তাদের বেশির ভাগই যাতায়াত করেন বাসে। তাদের জন্য এখন আরামদায়ক, নিরাপদ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব যাত্রা হবে এই রেলপথে। ঢাকা থেকে সড়কপথে কক্সবাজার যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রেলপথে সময় লাগবে শুরুতে ৮ ঘণ্টার কিছু বেশি। পর্যায়ক্রমে তা ৬ থেকে সাড়ে ৬ ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে চায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
নতুন এই পথে আন্তঃনগর, লোকাল, কমিউটার—সব ধরনের ট্রেনই চলাচল করবে। রেলওয়ে সূত্র বলছে, শুরুতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রেন চলাচল করবে। ধীরে ধীরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে আট জোড়া করা হবে।
ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন চট্টগ্রাম যায় তার সব কটিই কক্সবাজার পর্যন্ত যাবে। সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকেও আলাদা ট্রেন কক্সবাজার পর্যন্ত চলাচল করবে। এমনকি সিলেট, চাঁদপুরসহ অন্যান্য জেলার ট্রেনগুলোর গন্তব্য স্টেশন চট্টগ্রামের পরিবর্তে কক্সবাজার পর্যন্ত বর্ধিত করার পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত রেলপথগুলোর অন্যতম ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা। এ রুটে প্রতিদিন আন্তঃনগরসহ ১২টি ট্রেন চলাচল করে। কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালুর পর এটিই হবে সবচেয়ে ব্যস্ত, জনপ্রিয় ও লাভজনক রেল রুট।
২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেনের সংখ্যা ২০টিতে উন্নীত হতে পারে বলে মনে করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এজন্য আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজিয়েছে তারা।
আইকনিক রেলস্টেশন
এই রেলপথের প্রধান আকর্ষণ হবে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন।‘ঝিনুক’ আকৃতির এই আইকনিক স্টেশনটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে। ২৯ একর জায়গার উপর ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে সুন্দর রেলস্টেশনটি।এতে ফুটে উঠেছে কক্সবাজারের ঐতিহ্য।
এশিয়ার প্রথম শতভাগ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্টেশনটির ছয়তলা ভবনটি অপারেশনাল কাজের পাশাপাশি লিফট, এস্কেলেটর, ফুডকোর্ট, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, শপিংমল, রেস্তোয়া, এটিএম বুথ, পোস্টঅফিস, শিশু যত্নকেন্দ্র নানান সুবিধা। তারকামানের হোটেল,যাত্রীদের জন্য লকারের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কাজের জন্য নানান সুবিধা রয়েছে এই আইকনিক স্টেশনটিতে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক এই রেলস্টেশনে সময় কাটাতে পারবেন ৪৬ হাজার যাত্রী। প্রায় একলাখ যাত্রীকে প্রতিদিন সেবা দেয়া যাবে।
রেলওয়ে স্টেশনটিতে ট্রেনসংক্রান্ত কার্যক্রমের বাইরেও প্রদর্শনী কেন্দ্রসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। কক্সবাজার অঞ্চলের বিশেষ ট্রেড সেন্টার হিসেবে অনেকটা কাজ করবে এই আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনটি।
সকালে বা দুপুরে ট্রেন থেকে কক্সবাজারে নেমে সমুদ্র সৈকতে ঘোরাঘুরি শেষে যে কেউ রাতের ট্রেনে আবার নিজ গন্তব্যে যাত্রা করতে পারবেন। ইউরোপের রেলস্টেশনগুলোর মতো এখানেও লকারে জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। স্টেশনে তারকামানের হোটেলে রাতযাপন করাও যাবে ইচ্ছে করলে।
ডিসেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হলে সাশ্রয়ী, দ্রুত ও নিরাপদ যাত্রার জন্য যাত্রীরা এই রেলপথকেই বেছে নেবেন। এজন্য কক্সবাজারকে সামনে রেখে রেলের আগামী দিনের যাত্রী পরিবহন, পণ্য পরিবহনসহ আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
এই নতুন রেলপথ কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটাবে। হু হু করে বাড়বে পর্যটকের সংখ্যা। পর্যটকদের যাতায়াতে আর্থিক সাশ্রয় হবে। পর্যটন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
নতুন রেললাইন চালুর পাশাপাশি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ঘোরাফেরার জন্য নতুন নতুন স্পট তৈরি ও টেকনাফের সাবরাং ও মহেশখালীর সোনাদিয়ায় ইকো-ট্যুরিজম পার্ক তৈরির কাজ চলছে।
দেশের পার্বত্যাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম হয় বান্দরবানে। রেলপথ হওয়ায় সাতকানিয়া হয়ে স্বল্প সময়ে বান্দরবানে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি পার্বত্য জেলাটির উৎপাদিত পাহাড়ি কৃষিপণ্য সহজেই রেলপথে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে পৌঁছনোর সুযোগ তৈরি হবে।
উঁকি দিচ্ছে সোনালী ভবিষ্যৎ
এ রেল পথকে কেন্দ্র করে উঁকি দিচ্ছে সোনালী ভবিষ্যৎ। এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ২৯ কিলোমিটার পথ সংযোগ করে মিয়ানমারের কাছে গুমধুম পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। ফলে খুলে যাবে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হওয়ার সুযোগ।
পরবর্তী সময়ে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরও আসবে এই রেল নেটওয়ার্কের আওতায়।পাশাপাশি এক ডজনেরও বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল, টেকনাফ নৌবন্দরকে ঘিরে পূর্বাঞ্চল রেলের সবচেয়ে ব্যস্ত রুট হতে যাচ্ছে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত এ রেলপথ।
কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে। গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে। ফলে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশনের যুগে প্রবেশ করবে কক্সবাজার।
কক্সবাজারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে পর্যটন থেকে শুরু করে মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনালের মতো বিনিয়োগ আকর্ষণযোগ্য বড় বড় প্রকল্প। এসব প্রকল্পের ছায়াসঙ্গী হিসেবে যোগ হলো দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথটি।
এই রেলপথকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় পণ্য পরিবহনের হাব তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে পর্যটনের পাশাপাশি লবণ, কৃষি, আবাসন, চিংড়ি, শুটকি প্রভৃতি শিল্পে নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হবে। সুযোগ তৈরি হবনে বিপুল কর্মসংস্থানের। এ রেলসংযোগের ফলে সহজে ও কম খরচে এ অঞ্চলে উৎপাদিত মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্য পরিবহন করাও সম্ভব হবে। যার মাধ্যমে ঘুরে যাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
পর্যটন নগরীতে রেল: উঁকি দিচ্ছে সোনালী ভবিষ্যৎ মত-দ্বিমত মাহমুদুল হাসান শামীম