সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অপরাজনীতি
১৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১৩
স্বাধীন বাংলাদেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অপরাজনীতির সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের নৃশংসতম এই ঘটনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের দুই সদস্য শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়। পরিবার ও পরিবারের বাইরের সদস্য মিলে মোট ১৮ জনকে হত্যা করা হয় এদিনে, প্রায় একই সময়ে।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই খুনিচক্র ‘বাংলাদেশ বেতার’ দখল করে। নাম পাল্টে রাখে ‘রেডিও বাংলাদেশ’। আত্মস্বীকৃত খুনিদের অন্যতম মেজর ডালিম বেতার ভাষণে বলেন – “অদ্য সকাল হতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। শেখ মুজিব ও তার খুনি-দুর্নীতিবাজ সরকারকে উৎখাত করা হইয়াছে। এখন হইতে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হইল। আপনারা সবাই আমাদের সহিত সহযোগিতা করুন। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন কোনো অসুবিধা আপনাদের হইবে না। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক বেতার ভাষণে বলেন – “এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আজ দেশ এবং দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও দেশবাসীর উপর নির্ভর করে দেশের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নয়া সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। দেশের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী এই পদক্ষেপের সাফল্যের জন্য বীরের মতন এগিয়ে এসেছে।”
২৫ আগস্টে মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহকে অপসারণ করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সারাদেশে সামরিক বিধি জারি করে বেশ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করা হয়। মুখে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বললেও দেশে চলে সামরিক শাসনের তুঘলকি কাণ্ড। ১৯৭৫ সালের ৩০ আগস্ট এক সরকারি আদেশে সব রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই প্রথম রাজনীতি করার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। শুরু হয় অপরাজনীতির ধারা। খন্দকার মোশতাক তার অবৈধ মন্ত্রিসভায় আরও অনেককে ভয়ভীতির মুখে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলেও চার জাতীয় নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এইচএম কামরুজ্জামানকে বশে আনতে না পেরে কারাবন্দি করে।
এরপর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে জারি করা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’। অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের এই অধ্যাদেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষা করা। অধ্যাদেশের প্রথম অংশে বলা হয় – ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বিদ্যমান আইনের পরিপন্থি যাহা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের করা বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।’ অধ্যাদেশের দ্বিতীয় অংশে বলা হয় – ‘রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো।’
চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চড়াই উৎরাইয়ের উত্তাল সময়ের মধ্যে ৩ নভেম্বরের শেষরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করে খুনির দল কারাগারে প্রবেশ করে এবং জাতীয় চার নেতাকে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই রাতেই বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে খুনিচক্রকে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। খন্দকার মোশতাকের উপর বিদেশি প্রভু এবং দেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ন্যস্ত দায়িত্ব ছিল এই পর্যন্তই।
নীলনকশা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর এ সামরিক আইনের বিধি সংশোধন করে সুপ্রিমকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট মোশতাক ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ওই দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘… গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকরিচ্যুত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার-পরিজনদের হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক আইন জারি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সঙ্গে সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিল না। দেশবাসী আশা করেছিল, দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসবে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আমরা সবাই নিরাশ হয়েছি। দেশে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সম্প্রতি কারাগারে অন্তরীণ কিছু বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। …দেশে সামরিক আইন জারি রয়েছে। আমি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা এই দায়িত্ব ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অথবা সম্ভব হলে তার পূর্বেই পালন করতে বদ্ধপরিকর।’
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দিদশা (খালেদ মোশাররফ কর্তৃক) থেকে কর্নেল তাহেরের আনুকূল্যে মুক্তিলাভ করেন। মুক্ত হয়েই জিয়া দ্রুত দেশি-বিদেশি শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে কর্নেল তাহের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন এবং ক্ষমতার মূল কেন্দ্রের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন। যে কারণে প্রেসিডেন্ট সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণ দিতে বাধ্য হন। এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘… পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য আমরা কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে দেশে সামরিক আইন প্রশাসন কাঠামো গঠন করা হয়েছে। এই কাঠামোতে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। এতে তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন। তাঁরা হচ্ছেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, নৌবাহিনী প্রধান কমোডোর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তাওয়াব।‘ প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করবেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুজন রাষ্ট্রপতিই বেসামরিক হলেও তারাই হলেন প্রধান সামরিক শাসক!
১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এতে সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার এবং অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। শহিদদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭৬ সালের ৩ মে সরকারি এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। যে কারণে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ আবার তাদের তৎপরতা শুরু করে। রাষ্ট্র-সমাজ আর রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা।
১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই এক বিশেষ সামরিক আদালতে ‘সরকার উৎখাত ও সেনাবাহিনীকে বিনাশ করার চেষ্টা চালানোর’- অভিযোগে জাসদ নেতা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড এবং এমএ জলিল, আ.স.ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান সহ আরও অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি দেওয়া হয়। ২১ জুলাই ১৯৭৬ তারিখে আন্তর্জাতিক সকল আইনকানুন লঙ্ঘন করে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই বিচারপতি সায়েমের সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলবিধি জারি করে। আওয়ামী লীগ তাদের সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে। খুনি খন্দকার মোশতাকের নবগঠিত ডেমোক্র্যাটিক লীগ এবং স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকারি অনুমোদন পেলেও আওয়ামী লীগ নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য পত্র দেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত বিচারপতি সায়েমের সরকার ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে অনুমোদন দেয়। বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রায়ই বলে থাকেন, জেনারেল জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল করার অনুমতি দাতা। এ কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ, সে সময় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি সায়েম।
১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর, সেনাপ্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ গ্রহণ করেন। গ্রেফতার করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মোমেন তালুকদার, সালাউদ্দিন ইউসুফ, মোজাফফর হোসেন পল্টু, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং ন্যাপ নেতা মতিয়া চৌধুরীসহ আরও অনেককে।
লন্ডনের বিখ্যাত ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বলা হয়, ‘প্রশাসন ক্ষেত্রে সায়েমের (প্রেসিডেন্ট) কোনো ভূমিকা ছিল না এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তার সঙ্গে পরামর্শও করা হতো না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি পীড়াপীড়ি করছিলেন এবং শাসনক্ষমতা থেকে সামরিক বাহিনীকে বিদায় দেওয়ার জন্য তিনি ঘরোয়াভাবে শলা-পরামর্শ শুরু করেছিলেন। এখন তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। সায়েমকে অসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে এতদিন রাখা হয়েছিল জিয়ার সামরিক শাসনের চেহারা ঢেকে রাখার জন্য।’
১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বিচারপতি সায়েম পদত্যাগে বাধ্য হন এবং জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে বিচারপতি সায়েম বলেন ‘যেহেতু জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছেন, এবং আমার মনে হয়েছে যে, উপদেষ্টা কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যই তাকে সমর্থন করেছেন, তাই আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করি যে, তিনি নিজে কোন হুমকির সম্মুখীন না হয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বাবলী সামলাতে পারবেন কি না’ তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। … প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে আমি জিয়াকে বলি, আমি যেহেতু নির্বাচন করে যেতে পারলাম না, তাই আপনার প্রতি অনুরোধ করবো নির্বাচন আয়োজনের। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, তিনি নির্বাচন করবেন। শুনে আমি খুশি হই। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি যে, নির্বাচনে তিনি নিজেই অংশ নেবেন। সেরকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করবেন এমন চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি।’
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল জিয়া জিয়াউর রহমান তার ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য ৩০ মে ১৯৭৭ দেশব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। সে সময় দেশে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৬ জন। অবিশ্বাস্যভাবে সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, ৮৮.৫% ভোটার গণভোটে অংশ নিয়েছেন এবং জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ সূচক ভোট পড়েছে ৯৮.৮৮%। এ নির্বাচন প্রসঙ্গে বিচারপতি সায়েম বলেন – “বস্তুত জিয়া তার অবস্থান সংহত করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে একটা গণভোট করে ফেলেন। তার প্রতি এবং তার ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি ভোটারদের আস্থা আছে কি না তাই ছিল গণভোটের বিষয়। কিন্তু সেই গণভোটে হ্যাঁ বাক্সে এত বেশি ভোট পড়ে যে, জনগণ সেই ফলাফলকে হাস্যকরভাবে অবিশ্বাস্য মনে করে।” আওয়ামী লীগ এবং জাসদ ‘হ্যাঁ-না’ ভোট বর্জন করে।
১৯৭৮ সালের ৫ এপ্রিল জেনারেল জিয়ার সরকার বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে এক অধ্যাদেশ জারি করে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধীদের এবং বিদেশে পালিয়ে থাকা আলবদর-রাজাকারদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২৮ এপ্রিল ১৯৭৮ জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার একটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একমাত্র সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন।
বন্দুকের জোরে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের এ ধরনের নজির সারা বিশ্বে বিরল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জিয়া নতুন রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ সংক্ষেপে বিএনপি গঠন করেন। একই সঙ্গে দলের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেন। তখনো দেশে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি বা জিয়া সামরিক বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেনি।
১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া এক ফরমান জারি করে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে প্রায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর নির্বাচনি প্রচারের স্বল্প সুযোগ দিয়ে ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৯ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলসমূহ আপত্তি জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন এক ঘোষণায় ২৭ জানুয়ারির পরিবর্তে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করে।
সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় এবং নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় থাকলেও সামরিক সরকারের মুখোশ উন্মোচন এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলসমূহ এ নির্বাচনে অংশ নেয়। ক্ষমতাসীন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে।
অপরাজনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিলে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই জারি করা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ । এটি মোশতাকের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের চেয়ে আরও ভয়াবহ, আরও অনেক বেশি নির্মম। এই আইনে বলা হলো – “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ ১) এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইলো, ২) ওই সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা বৈধভাবে প্রণীত, কৃত ও গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং ৩) তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
এই আইনের অর্থ দাঁড়াল এরকম – ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে সংঘটিত বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু রাসেলসহ ১৮ জনের হত্যা বৈধতা পেল এবং বলে দেওয়া হলো কোথাও এর কোনো বিচার চাওয়া যাবে না’ ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বরে জাতীয় চার নেতার জেল হত্যা বৈধতা পেল এবং বলে দেওয়া হলো কোথাও এর কোনো বিচার চাওয়া যাবে না, ‘৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বরে বাতিলকৃত দালাল আইন বাতিলই থাকবে, ফিরিয়ে আনা যাবে না, ১৯৭৬ সালের ০৩ মে এ সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, খুনিচক্রকে বিদেশে পাঠানো এবং বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।
খালেদ মোশাররফ হত্যার বিচার, কর্নেল তাহের হত্যার বিচার, সেনা ক্যুতে নিহত হাজার হাজার সামরিক সদস্যদের বিচার বহির্ভূত হত্যার বিচার – কোনো কিছুর ব্যাপারেই বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, মামলা পর্যন্ত করা যাবে না, ‘৭৭ এর প্রহসনের হ্যাঁ – না গণভোটকে বৈধতা দেওয়া হলো’ সবচেয়ে বড় কথা – অসাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়া হলো! জিয়াউর রহমানের এই ইনডেমনিটি আইনের চেয়ে বড় ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালের এই ইনডেমনিটি আইনের মাধ্যমেই— যার খেসারত আমরা আজও দিয়ে চলছি।
লেখক: উপ-উপাচার্য, বুয়েট
সারাবাংলা/আইই