Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইশতেহারে পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশের অঙ্গীকার চাই

রাজন ভট্টাচার্য
২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:১০

সময়ের কারণে দেশে কৃষি অর্থনীতির কলেবর আগের চেয়ে বহুগুন বেড়েছে। অনেক কৃষিপণ্য এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানের সূচক খুবই খারাপ পর্যায়ে। গেল ২০ বছরে পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এর সবকটিতেই দেশের অবস্থান তলানিতে। দিন দিন এই সূচক নামছে। এর একটি বড় কারণ হলো নিত্য ব্যবহার্য ‘পলিথিন’।

বিজ্ঞাপন

কৃষি ও কৃষকের দেশে পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিনের এই অস্বাভাবিক উত্থান সত্যিই বিস্ময়কর। সোনালী আঁশ পাটকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগি ব্যবসায়িরা রাষ্ট্রের সঙ্গে আপোস কওে সহজলভ্য পলিথিন সামনে এনেছে। এখন নিষিদ্ধ এই পণ্য প্রকাশ্যে ছেয়েছে গোটা দেশ। যেমন দেশে ইজিবাইক আমদানি নিষিদ্ধ। অথচ নানা হিসাবে দেখো গেছে, সারাদেশে এই নিষিদ্ধ যানের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। এর বাইরেও অনুমোদনহীন যানবাহন প্রায় ৪০ লাখ। অনুমোদনহীন বাহনের অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে কোটির বেশি মানুষ। বিকল্প আবিস্কারের মধ্য দিয়ে এসব যানবাহন বন্ধ একটু সময় সাপেক্ষ হলেও পলিথিন বন্ধ করা কি সময় সাপেক্ষ?

বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকলেই পরিবেশ বিনষ্টকারী পলিথিন বন্ধ সম্ভব। সবার আগে একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে, তা হলো- এই পলিথিন কৃষি, পরিবেশ, মাটি দূষণ সহ জনস্বার্থের দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর। কৃষি প্রধান দেশে কৃষি উৎপাদনের তো বিকল্প নেই। তেমনি দূষণের হাত থেকেও মুক্তি পথে সময়ের দাবি। এসব বিবেচনায় পলিথিন উৎপাদন বন্ধ কি জরুরী নয়?

পলিথিন নষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে না। উল্টো মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। পুড়িয়ে দিলেও মাটি হয় না। সর্বোপরী পলিথিন অপকারের চেয়ে উপকার বেশি করছে তা কোনভাবেই বলা যাবে না। প্রশ্ন হলো পলিথিনের বিকল্প কিছু নেই? যখন ক্ষতিকর এই পণ্যটি দেশে উৎপাদন হতো না, তখন কি বিকল্প কিছু ছিল না?

এক কথায় পলিথিনের দ্রুত বিকল্প হলো পাটের বেগ। যা শতভাগ পরিবেশ সম্মত। স্বদিচ্ছা থাকলেই পাট উৎপাদন বাড়িয়ে বেগ উৎপাদন করা সম্ভব। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি পলিথিন বন্ধ করে পাটের বেগ তৈরীর ঘোষণা দিয়েছিল। জেলায় জেলায় বেগ সরবরাহে এজেন্ট নিয়োগেরও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। জানিনা কি কারণে পরিবেশ ও পাট-ব¯্র মন্ত্রণালয়ের সেই উদ্যোগ এখনও কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ।

প্রশ্ন হলো পলিথিন বাদ দিয়ে পাটের যুগে ফেরত যেতে করণীয় কী? প্রথমত রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা। এই স্বদিচ্ছাই পারে পাটের সোনালী যুগে কৃষকদের ফিরিয়ে নিতে। এজন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। আগামী সাত জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগেই দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো জাতির সামনে নির্বাচনী অঙ্গীকার তুলে ধরবে। প্রতিশ্রুতিতে পলিথিন বন্ধ করে পাটের বেগ বা বিকল্প পরিবেশ সম্মত কিছু উৎপাদনে সকল রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার প্রয়োজন। যারাই ক্ষমতায় আসবে সেই দল, অগ্রাধিকার প্রতিশ্রুতি হিসেবে তা বাস্তবায়ন করবে। বিরোধী দলগুলোও ছায়া সরকার হিসেবে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করলে দ্রুত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব।

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে পলিথিন উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের পক্ষ থেকে বিণিয়োগ, বিপুল সংখ্যক মানুষের বেকার হওয়া থেকে শুরু করে আর্থিক ক্ষতির কথা যুক্তি হিসেবে উপস্থ্াপন করা হবে। তেমনি অর্থ দিয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত ঠেকানোর চেষ্টা কম হবে না। সরকার যদি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকে, তাহলে কোন কিছুই সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা নয়।

এক্ষেত্রে পাটের বেগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পলিথিন উৎপাদনে যুক্তদের কাজে লাগানো যেতে পারে। তাহলে এ খাতে নিয়োজিত জনশক্তি বেকার হবে না, তেমনি বিণিয়োগকারী ব্যবসায় টিকে থাকার বিকল্প পাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে পাটের পণ্য উৎপাদনের নামে আবারো যেন পলিথিনের জন্ম না হয়। সবার আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিক অঙ্গীকার হিসেবে সকল পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানা গুড়িয়ে দিতে হবে। এ নিয়ে কোন আপোস নয়। তাহলে মানুষ এমনিতেই বিকল্পের দিকে যাবে।

দীর্ঘ ১৫ বছরে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষায় ওয়ান টাইম পাটের বেগের প্রচলন করা অসম্ভব ছিল না। বাজারে নিত্যপণ্য বহনের ক্ষেত্রে পলিথিনের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। যা পটের বেগ দিয়ে আরো স্বাচ্ছন্দে সম্ভব। এক সময়ে তো দেশে পলিথিন ছিল না। তখন সবাই কাপরের বেগ নিয়ে বাজারে যেত। পলিথিন সহজলভ্য হওয়ায় হাত থেকে বেগ নেমেছে।

পলিথিন বন্ধ করে পাট উৎপানে যেতে পারলে কৃষকরা এই পণ্য উৎপাদনে ঝুঁকবে। এ কাজে তাদের উৎসাহ যেমন বাড়বে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হবেন। উৎপাদন বাড়লে জেলায় জেলায় ছোট ছোট পাটের বেগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। এতে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হবে। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে আরো ভাল।

বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে পলিথিন। মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না। মাটির নিচে পানি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মাটির স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। মাটির গুনগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পায়। শস্যের ফলন কমে। এমনকি শুধু মাটির নিচের ওসব পলিথিনের কারণে গাছও তার প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। গাছ দুর্বল হওয়া মানে, কম অক্সিজেনের উৎপাদন। যার ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। কারণ গাছ এসব গ্যাস গ্রহণ করে।

অক্সিজেনের স্বল্পতার একটি অন্যতম প্রভাব হচ্ছে হাঁপানী কিংবা শ্বাসরোগ প্রভৃতি হওয়া। রাজধানীর জলাবদ্ধতা, খাল ও নদী ভরাট হচ্ছে পলিথিনের কারণে। এখানেই শেষ নয়, সাগর ও নদীর তলদেশে পলিথিন জমায় মাটি, পানি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র এবং সামুদ্রিক জীবের ক্ষতি করে এবং যেসব প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহারের অনুপযোগী, তা মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। প্লাস্টিক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করে এবং প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে, এবং ক্যানসারের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্লাস্টিক দূষণে বিশ্বের মধ্যে দশম বাংলাদেশ। সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়।

এদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪ হাজার প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ২০ লাখের বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
পরিবেশসংক্রান্ত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির একটি পজিশন পেপার থেকে জানা যায়, পলিথিন বা প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।

শেষ কথা হলো, কিছু পণ্য বাজারজাত করতে পলিথিন উৎপাদনের অনুমতি রয়েছে। এই বিবেচনায় সরকারের তরফ থেকে এই পণ্যের শতভাগ উৎপাদন বন্ধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এটি মেনে নেয়ার মতো যুক্তি নয়। প্রাথমিকভাবে যদি নিত্যপণ্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করা যায় তাহলে বিকল্প হিসেবে পর্যায়ক্রমে পাটের বেগের প্রচলন মোটেই দূরহ কাজ নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইশতেহারে পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশের অঙ্গীকার চাই মত-দ্বিমত রাজন ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর