হরতাল অবরোধের নামে বিএনপির রঙ্গতামাশা
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:০০
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বানচাল বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো তথাকথিত হরতাল অবরোধ পালন করে যাচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে ইতোমধ্যে বার দফায় বাইশ দিন অবরোধ এবং চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল কর্মসূচি পালন করেছে। হরতাল অবরোধ করে দলীয় নেতাকর্মী নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করা রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তারা সেটা না করে চোরাগোপ্তা হামলা করে গাড়ী ভাংচুর সহ মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন করে যাচ্ছে।
গত ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির কথিত শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ সংঘর্ষ সংঘাতে অশান্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের বেপরোয়া আক্রমণে পুলিশ সহ একাধিক ব্যক্তি হত্যাকান্ডের শিকার হন। প্রধান বিচারপতির বাসভবন সহ একাধিক সরকারি স্থাপনায় ভাংচুর করা হয়। পরদিন থেকে বিএনপি হরতালের ডাক দেয়। প্রথম দিকের হরতাল অবরোধে মানুষ আতংকে কিছুটা কম রাস্তায় বের হলেও আস্তে আস্তে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসে। শুরুতে দলীয় কর্মীরা যানবাহনে আগুন দিলে, সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ে দলীয় সন্ত্রাসীরা হয় গ্রেফতার নতুবা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হলেও তাদের কাজ সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে দল পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন ভিডিও লাইফ করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে, প্রকাশ্যে কোনো নেতাকে দেখা যাচ্ছেনা। নেতারাই হরতাল অবরোধ দিয়ে নিজেরাই পালন করে না। প্রথম দিকে গুটিকয়েক কর্মী মাঠে নামলেও এখন তাদের একদমই দেখা যায় না। কিছু লোককে টাকা দিয়ে ভাড়া করে গাড়ী পোড়ানো এবং নিরীহ মানুষের ক্ষতি করাই তাদের অবরোধ কিংবা হরতাল পালনের সার্থকতা।
বিএনপি কখন হরতাল দিবে, কখন অবরোধ দিবে নিজেরাই জানেনা। কোনটা হরতাল,আর কোনটা অবরোধ সে পার্থক্যটাই বোঝেনা। দুইটি রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে মিল থাকলেও হরতাল ও অবরোধের মৌলিক বড় কিছু পার্থক্য আছে। কর্মসূচি পালনে জনগণকে বাধ্য করার নাম অবরোধ। সড়ক, নৌ ও রেলপথ অবরোধে জনগণকে বাধ্য করা হয়। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গাড়ী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। এখানে জনগণের মতামতের কোনো মূল্য থাকেনা। তাদেরকে কর্মসূচি পালনে একপ্রকার বাধ্য করা হয়। অবরোধের দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। গ্রিক উপাখ্যানে ইলিয়াড় ও ওডেসিতে ট্রয় নগরীতে অবরোধের কথা উল্লেখ আছে। ট্রয় নগরীতে রানী হেলেনকে অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর অবরোধের কারণে ঘটনাবহুল যুদ্ধে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল।
অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধী হরতাল শব্দটি ব্যবহার করেন। হরতাল হচ্ছে সর্বাত্মক ধর্মঘট। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। হরতালের সময় জনগণ নিজের তাগিদেই অফিস-আদালতে যাবে না, দোকানপাট ও যানবাহন বন্ধ রাখবে। তবে এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম সহ জরুরি সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান সমুহ সবসময় হরতালের আওতামুক্ত থাকবে। বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশে জনগণের যেকোনো ন্যায় সংগত দাবি আদায়ে হরতাল বা ধর্মঘট কার্যকর ভুমিকা রেখেছে। ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলায় ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবিতে ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রথম হরতালের ডাক দেয়। এরপর থেকেই এদেশের রাজনীতিতে হরতাল একটি প্রচলিত কর্মসূচি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। তবে অবরোধের থেকে বড় কর্মসূচি হরতাল। কারণ অবরোধে জনগণকে বাধ্য করা হয়,আর হরতালে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। হরতালকে আন্দোলনের সর্বশেষ হাতিয়ার বলা হয়।
হরতালের রাজনীতি বাংলাদেশে পুরনো হলেও আগুন সন্ত্রাসের সংস্কৃতি চালু করে বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বানচাল করতে জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি চালু করে। তারপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ করতে ভয়াবহ তান্ডব চালিয়েছিল। হাজার হাজার যানবাহন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পবিত্র উপাসনালয় মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা কিছুই বাদ যায়নি। হাসপাতাল গুলোতে দগ্ধ মানুষের আহামরিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। নির্বাচনের দিন প্রিসাইডিং অফিসারসহ ২৬ জন মানুষকে হত্যা ও প্রায় ছয়শত ভোটকেন্দ্রে আগুন দিয়েছিল। এসব বাধা অতিক্রম করেও জনগণ ভোট দিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে পরের বছর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি জোট গণতন্ত্র হত্যা দিবসের নাম করে লাগাতার অবরোধ ডেকেছিল। তিন মাসের অবরোধে শতাধিক মানুষ নিহত ও দেশের বিপুল সম্পদ নষ্ট করেছিল। পেট্রোলবোমার ক্ষত নিয়ে এখনও অনেক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। সেসময়কার সহিংসতার আতংক এখনও মানুষের মাঝে উৎকন্ঠা বিরাজ করে। তিন মাস হরতাল অবরোধ চলার পর ঘোষণা দিয়েছিল অবরোধ চলবে। সেই অনির্দিষ্টকালের অবরোধ আর কখনো প্রত্যাহার করেনি। তখন তারা পেট্রোল বোমা মেরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমণ, নিরীহ মানুষ হত্যা করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, ট্রেন, যাত্রীবাহী লঞ্চ, ভূমি অফিস সহ অনেক সরকারি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
হরতালের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা জনগণের আইনগত অধিকার। তবে হরতালের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধন করা আইন বিরুদ্ধ কাজ। তখন হরতালকারিদের নিবৃত্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। কখনো কখনো গ্রেফতারও করা হয়। বিএনপি বারবার আগুন সন্ত্রাস করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বত্তদের পরাভূত করে দেশকে দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসে। বিজয়ী হয় গণতন্ত্র,যার ধারাবাহিকতা বর্তমানেও চলমান রয়েছে। আগের থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নাশকতা ও সহিংসতা চালিয়ে দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসীরা সহজে পার পাচ্ছে না। সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ, মোবাইল ট্রেকিং সহ আধুনিক প্রযুক্তির কারণে দুর্বৃত্তদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনা সম্ভবপর হচ্ছে। যার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজেরা না এসে ভাড়া করা লোকজন দিয়ে নাশকতা করছে।
বিএনপি পশ্চিমাদের সমর্থনের আশায় সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেছিল। কিন্তু আগুন সন্ত্রাসের কারণে বিএনপির উপর বিদেশিদের সমর্থন চলে গেছে। একসময় যেসব বিদেশি দূতাবাস নির্বাচন নিয়ে খুব সরব ছিল, তারাই বিএনপির নেতিবাচক কার্যক্রমে চুপসে গেছে। তারা বুঝে গেছে বিএনপি জোট মুখে যা-ই বলুক না কেন তাদের শক্তির জায়গা জনগণ নয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
আন্দোলনের সফলতা নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উক্তি খুবেই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। নিঃস্বার্থ কর্মী থাকতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।’ জাতির পিতা যে কথা গুলো বলেছেন, তার একটি নমুনাও বিএনপিতে দেখা যায় না। তাদের সমর্থক থাকলেও আন্দোলন করার মতো নিঃস্বার্থ কর্মী নেই। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো ইস্যু নেই। সর্বোপরি জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য কোনো নেতৃত্ব নেই।
বিএনপির হরতাল অবরোধ জনগণ তো দূরের কথা তাদের নেতাকর্মীদেরই আস্থা নেই। নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম জনগণ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার না করলে তাদের পরিনতি হবে মুসলিম লীগের মতো। জন বিছিন্ন হয়ে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের তর্জন গর্জন অসার নিজেরাই শক্তি হারিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। এখন তাদের হরতাল অবরোধের কর্মসূচি হাস্যকর রঙ্গতামাশায় পরিনত হয়েছে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই