Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘তারা তো রাজনীতি করে না, পুড়িয়ে মারা হলো কেন?’

প্রভাষ আমিন
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:০৫

মঙ্গলবার দিনটি শুরু হলো অমঙ্গল দিয়ে। ঘুম ভেঙ্গেছে ট্রেনে আগুনে পুড়ে চার যাত্রীর মৃত্যুর খবর দিয়ে। খবরের সাথে এমন কিছু ছবি দেখেছি, যা কখনোই টেলিভিশন দর্শকদের দেখানো যাবে না। কিন্তু পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মানুষের ছবি আমার স্মৃতিতে দাউ দাউ করে জ্বলবে বহুদিন। এই নৃশংসতা আমাকে ঘুমাতে দেবে না অনেক রাত।

সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে থাকা বিএনপি মঙ্গলবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই বিএনপি দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ ডাকছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সে আন্দোলনে সাড়া দেয়নি। বিএনপি হরতাল বা অবরোধ ডাকে গোপন জায়গা ধেকে। নেতাকর্মীরা কেউ মাঠে থাকে না। হরতাল বা অবরোধের আগের দিন গাড়িতে আগুন দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে। তবে গাড়িতে আগুন দিয়েই জনগণের প্রতি তাদের প্রতিশোধস্পৃহা শেষ হয়নি। দুর্বৃত্তরা ভেবেছে, ট্রেনে নাশকতা করতে পারলে একসাথে অনেক ক্ষতি করা যাবে। গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইলে একটি কমিউটার ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এতে ট্রেনটির দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর দুদিন পর ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়িতে ‘যমুনা এক্সপ্রেসে’ আগুন দেওয়া হয়। এতে ট্রেনটির দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২২ নভেম্বর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ সিলেট স্টেশনে থাকা অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও একটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর গত ১৩ ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধের মধ্যে গাজীপুরের ভাওয়ালে রেল লাইন কেটে ফেলায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি বগিসহ উল্টে পড়ে। সেই ঘটনায় একজন মারা যায়। এবার আগুনে পুড়লো সেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। শুধু ট্রেন নয়, পুড়লো চারজন মানুষও।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও আমরা একই ধরনের সহিংসতা দেখেছি। কিন্তু সহিংসতা দিয়ে নির্বাচন ঠেকানো যায়নি। এবার আবার বিএনপি মাঠে নেমেছে সহিংসতা দিয়ে নির্বাচন ঠেকানোর কৌশলে। সহিংসতায় তো সাধারণ মানুষ পোড়ে, সরকারের তো কিছু যায় আসে না। তাহলে লাভ কী? বিএনপি কি জনগণকেই তাতের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে?

বিএনপির ডাকা হরতাল শুরু হওয়ার কথা ছিল ভোর ৬টা থেকে। কিন্তু তার আগেই আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে। ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, যাত্রী বেশেই ট্রেনে উঠেছিল দুর্বৃত্তরা। বিমানবন্দর স্টেশনে পেট্রোল বা কোনো রাসায়নিক দিয়ে আগুন লাগিয়ে হয়তো তারা নেমে গেছে। আর আগুন নিয়েই ট্রেনটি এসে থামে তেজগাঁও স্টেশনে। আগুন নিভিয়ে ফায়ার সার্ভিস ট্রেন থেকে উদ্ধর করে চারজনের মরদেহ। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পুড়ে যাওয়া তিনটি বগি সাক্ষ্য দিচ্ছে আগুনের ভয়াবহতার। পুড়ে যাওয়া বগিতে পড়ে আছে স্কুলব্যাগ, হোমিওবাক্স, পুড়ে যাওয়া বই, কারো চশমা, ঔষধ, স্যালাইনের প্যাকেট। একটু আগেই যেখানে ছিল জীবনের জয়গান, এখন সেখানে শুধু ছাই।

ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন মিজানুর। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায়। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গত ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী নাদিরা আক্তার পপি গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যান। সেখান থেকেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন নাদিরা। সাথে ছিল দুই ছেলে ফাহিম আর ইয়াসিন এবং কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই হাবিবুর রহমান। সোমবার রাতে ট্রেনে ওঠার পরও স্বামী মিজানুরের সাথে কথা হয়েছে নাদিরার। মিজানুর অপেক্ষা করছিলেন স্ত্রী-সন্তানদের ফেরার। কিন্তু মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে শ্যালক হাবিবুরের ফোনে ট্রেনে আগুনের খবর পান মিজানুর। গিয়ে দেখেন, চারটি লাশের মধ্যে তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেও আছে।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী মা। সন্তানকে রক্ষায় মা সবকিছু করতে পারেন। পত্র-পত্রিকায় নাদিরার একটি ছবি ছাপা হয়েছে। তিনবছরের ছেলে ইয়াসিনকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে হয়তো নেয়া ছবিটি। পুড়ে যাওয়ার পরের নাদিরার ছবিটিও এমনই। সন্তানকে আগলে রেখেছেন কোলে। সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, পারেননি। নিজেও বাঁচতে পারেননি। ভাই হাবিবুর বড় ছেলে ফাহিমকে নিয়ে নামতে পারলেও নাদিরা তার তিনবছরের ছেলে ইয়াসিনকে কোলে নিয়েই ছবি হয়ে গেছেন। এই ছবি দেখে পুলিশ-ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের চোখেও পানি এসেছে।

নাদিরার স্বামী মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। আমার ভেতরে কী চলছে এটা বোঝাতে পারব না। আমার তো সবই শেষ হয়ে গেল। কী অপরাধে আমার সব শেষ হয়ে গেল জানি না।’

নাদিরার দেবর মিনহাজুর রহমানের কণ্ঠেও হাহাকার, ‘আমার ভাবি ও তার সন্তান রাজনীতি করে না। কিন্তু হরতালের সময় কেন তাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো?’ এই প্রশ্নের জবাব কি আছে কারো কাছে?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

‘তারা তো রাজনীতি করে না- পুড়িয়ে মারা হলো কেন?’ প্রভাষ আমিন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর