নির্বাচনে ভোটের হার কত হতে পারে?
৩ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:১১
অনেক চাপ-হুমকি, গুজব-অপপ্রচার, আন্দোলন-বয়কট, সংকট-আশংকা,জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জমজমাট প্রচারণা এবং উৎসব আবহে জাতি প্রস্তুত আরেকটি নির্বাচনের জন্য। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা্। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই বলেছেন এবারের নির্বাচন হবে অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ। ভোটাররা নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন এমন পরিবেশ নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, নির্বাচন কমিশন বাতিল করা এবং তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মতো অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক দাবীতে নির্বাচন বয়কট করছে বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো। নির্বাচন ঠেকাতে তারা ৬০ বারেরও বেশি হরতাল-অবরোধ ডেকেছে । বাস-ট্রেন-ট্রাক জ্বালিয়ে, ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলে, বাসে ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করে তারা নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশাসন দৃঢ়তার সঙ্গে এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মোকাবেলা করে নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করছে।
বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলোর যে দাবী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং তত্বাবধায়ক সরকার এ ব্যাপারে কখনও কোন কথা বলেনি বিদেশীরা যারা বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে সরব। তারা বলেছে অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের কথা। যেটি সবসময় বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। শেষ পর্যন্ত বিদেশীরা শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল। শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছিল আওয়ামিলীগও । কিন্তু তাতেও সাড়া দেয়নি বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো। ফলে তাদের ছাড়াই হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
কোন বড় দল নির্বাচনে অংশ না নিলেই কি সেটি অংশগ্রহণমুলক নির্বাচন হবে না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বয়কট করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ২টি আসন ছাড়া বাকী সব কটি আসনে জিতে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বয়কট করার পরও কি সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি? সেটি কি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি?
এবারের দ্বাদশ নির্বাচনে নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ২৮টি দল অংশ নিচ্ছে। ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন ১৯৭০ জন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন ৪৩৬ জন। প্রার্থীর সংখ্যায় অতীতের নির্বাচন গুলোর থেকে পিছিয়ে নেই এবারের নির্বাচন। ৩০০ আসনের জন্য ৪২ হাজার ১৪৯টি সেন্টারে ২ লক্ষ ৬২ হাজার পোলিংবুথে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৭ জন ভোটারের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন।
এখন দেখার বিষয় এই ভোটারদের কত শতাংশ ভোট দিতে আসেন। গেল ১১টি নির্বাচনের পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় প্রতিটি নির্বাচনে গড়ে ৫৯% ভোট পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ৮৬% ভোট পড়েছে ২০০৮ সালে আর সবচেয়ে কম ১৫% ভোট পড়েছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। এসব হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি দুই সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান এবং হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের রেফারেন্ডামগুলোর ভোটের হিসাব।
ভোটের হার কত হবে?
এবার কত শতাংশ ভোটার ভোট দিবেন- সেটি এখন আলোচনার বড় এক বিষয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় মৃত্যু এবং অবস্থান বদলের কারণে প্রায় ১৫% ভোট বাদ পড়ে। নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপি-জামাত ও তাদের সমমনা দলগুলোর হার্ডকোর সমর্থক প্রায় ৩৫%। দলের নির্দেশনা মানলে এদের ভোট না দেয়ারই কথা। ফলে প্রায় ৫০% ভোট বাদ পড়াটা স্বাভাবিক। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে ৩০% থেকে ৪০% ভোটার এমনিতেই ভোট দিতে যান না। এবারও এমন সংখ্যক ভোটার হয়তো ভোট দেবেন না। তাহলে সাম্ভাব্য ৫০% ভোটার থেকে বাদ যাবে আরো ১৫% থেকে ২০% শতাংশ ভোটার। তারমানে বাস্তব সম্মত ভোটের হার হতে পারে ৩০% থেকে ৩৫% শতাংশ।
তবে ভোটের হার বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে তরুণ ভোটাররা। এবার নতুন ভোটার হয়েছেন ১ কোটি ৫৪ লাখ। আগে একটি নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন এমন ভোটার আছেন আরো প্রায় ১ কোটি তরুণ। ফলে সব মিলিয়ে প্রায় আড়াইকোটি তরুণ ভোটার রয়েছেন। এই ভোটাররা যদি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে, নাগরিক দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হন তবে ভোটের হার বেড়ে যাবে।
ভোটের আরেটি বড় অংশ নারী ভোটার। প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি ৮৯ লাখ ভোটারই নারী। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বিপুল সংখ্যক নারী ভোট দিতে আসবেন। এ ক্ষেত্রেও ভোটের হার বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ভোটের হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করতে নির্বাচন কমিশন প্রথম থেকেই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নজীর বিহীনভাবে তারে সব ডিসি ও সব থানার ওসিকে বদলি করেছে। অসংখ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ টিম করেছে ম্যাজিস্ট্রেটদের তত্বাবধানে। নির্বাচনী আচরন বিধি ভঙ্গের জন্য বাঘা বাঘা অনেক প্রার্থিকে তলব করে সতর্ক করেছে। জরিমানা করেছে। মিথ্যা তথ্য দেয়া ও হুমকি-ধামকি দেয়ার কারণে কোন কোন প্রার্থীর প্রার্থীতাও বাতিল করেছে। মামলা করে গ্রেপ্তারও করেছে। কোন ধরণের অনিয়ম হলে সঙ্গে সঙ্গে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয়ারও হুশিয়ারি দিয়েছে। সব মিলিয়ে ভাল একটি নির্বাচন আয়োজেন নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে আশা করা যায় নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে। ফলে তরুণ ভোটার ও নারী ভোটারদের ভোট দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাধ্যতামূলক ভোট
এবারের নির্বাচনে ভোটের হার নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই প্রস্তুত হয়ে আছেন ভোটের হারের ভিত্তিতে তারা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলবেন। আর অন্য দল অপেক্ষা করছে ভোটের হার কম হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঘোষণার জন্য। এই পরিস্থিতি ভোট বাধ্যতামূলক করার নতুন চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে। পৃথীবির অনেক দেশেই নাগরিকদের ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। প্রথম রাস্ট্র হিসেবে বেলজিয়াম ১৮৯২ সালে পুরুষদের জন্য এবং ১৯৪৯ সালে নারীদের ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক করে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, সাইপ্রাস, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, পেরু, সিঙ্গাপুর সহ ২২টি দেশে নাগরিকদের ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। এসব দেশে ভোট না দিলে আর্থিক জরিমানা, ভোটাধিকার বাতিল, সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা এবং নানান ধরণের শাস্তি পেতে হয়।
আমাদের দেশেও বাধ্যতামূলক ভোটের ব্যাপারটি ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমাদের সংবিধানের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক হলে সংবিধান সংশোধন করে ব্যবস্থাটি চালু করা যেতে পারে। সরকারের সরাসরি বিভিন্ন সুবিধাভোগ করেন এমন ভোটার রয়েছেন প্রায় ২ কোটি ৭৫ লাখ। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধাসরকারি কর্মচারি মিলে মোট সোয়া ৩ কোটি ভোটার রয়েছে। রাস্ট্রের সুবিধাভোগী এসব ভোটার কেন ভোট দিবেন না সে প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক ( এ নিয়ে সম্প্রতি আদালতে একটি রিটও হয়েছে)। তারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন পছন্দের দল প্রার্থীকে ভোট দিবেন- এটি নাগরিক দায়িত্ব। কোন কোন দেশে যেমন আর্থিক জরিমানা করা হয়, শাস্তি দেয়া হয় তেমনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও এটি বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যেমন ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে তেমনি কারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন কারা করেন নি সেটিও বিবেচনা করা উচিত। অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন যেমন সরকারের রাস্ট্রীয় দায়িত্ব তেমনি নির্বাচনে ভোট দেয়াও জনগণের নাগরিক দায়িত্ব।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এজেডএস