গণতন্ত্রের উৎসবে পরাজিত হবে ষড়যন্ত্র
৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:১৪
দ্বাদশ সংসদ নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশি-বিদেশি চক্র অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। নির্বাচনে কয়টি দল অংশগ্রহণ করলে কিংবা কত শতাংশ ভোট পেলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে এমন কোনো কথা আমাদের সংবিধানে নেই। বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচনে জয় পেতে ন্যূনতম ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ভোট প্রদানের হার এক শতাংশের কম হলেও নির্বাচন নিয়ে আইনগত ভাবে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
বিএনপি নির্বাচনে নেই বলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবেনা, এমন কথা বিদেশি কেউ বলছেন না। নির্বাচনে আসা বা না আসা সম্পূর্ণ সেই রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিন্ধান্ত। কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসলো কি না সেটা বড় বিষয় নয়। জনগণের অংশগ্রহণই মূখ্য বিষয়। জনগণ যদি ভোটে অংশগ্রহণ করে সেটাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কারণ জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।
নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক হলেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। গড়ে চল্লিশ শতাংশ বা তার বেশি ভোট উপস্থিত হলে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দেয়া হয়। উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো মনে করে একটি দেশে যদি চল্লিশ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়, তাহলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, এটাই আন্তর্জাতিক রীতি। আর সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে বুঝায়, যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে তারা যেন সমান সুযোগ পায়, ভোটে যেন কোনো কারচুপি না হয় এবং জনগণ যেন ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, জনগণ যেন স্বাধীন ভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রদান করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা।
নির্বাচন কমিশন যে একটি স্বাধীন সংস্থা এটি তারা এবার বারবার প্রমান করছেন। অনিয়ম হলে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রভাবশালী নেতানেত্রীদের মনোনয়ন বাতিল করতে একবারও ভাবেন নি। অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদদের আচরণবিধি লংঘনের অপরাধে জরিমানা গুনতে হয়েছে। এবং বিধিমালা লংঘনের কারণে প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের মতো ঘটনাও ঘটেছে। যা এবারই প্রথম। এবার প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ কেউ করেনি। বরং সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মী ক্ষমতার জাহির করতে গিয়ে প্রশাসনের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। প্রশাসনের কারো বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পেলে দ্রুতই তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
অস্বীকার কারার উপায় নেই, এবারের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা কিছু দেশ সরকারের উপর এক ধরনের চাপ দিয়ে আসছিল। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। নির্বাচনকে যারা বাধা দিবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে বলে হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে। বিদেশিদের হুমকি ধামকি সরকার পাত্তা দেয়নি। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর তারা নির্বাচন কমিশনকেও একই ধরনের চাপ দিতে থাকে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপের কথা স্বীকার করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচনে বিদেশিদের থাবা পড়েছে। সেজন্য দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের কোনো বিকল্প নেই। ‘অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সরকারও কোনো প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে না। যার কারণে নির্বাচন কমিশন ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে সব প্রকৃয়াই গ্রহণ করেছে।
বিএনপি সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভোটে না আসায় অনেকেই ভেবেছিল ভোট অংশগ্রহণ হবে না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার একটি সিন্ধান্ত, দলীয় নেতা-কর্মীরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে, এমন ঘোষণার পর শুধু প্রার্থীর সংখ্যাই বাড়েনি। অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের বাহিরেও বিরোধী দলের অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এবং ভোট একটি উৎসবে পরিনত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬৬ জন প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৪৩৬ জন। নিবন্ধিত ৪২ টি দলের মধ্যে ২৮ টি দল অংশগ্রহণ করেছে।
নির্বাচন সুন্দর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য কেউ যাতে বিনা যুদ্ধে জিততে না পারে সেজন্য দলীয় প্রার্থীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এবং দলীয় নেতাকর্মীদের কেউ যদি ভোটের বিঘ্নিত করে তাহলে কঠোর শাস্তির হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে। দলীয় প্রধান নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সবাই নির্বাচন আচরণবিধি মেনে ভোট চাইবেন। জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে। জনরায় মেনে নিবেন। ভোট চাওয়ার অধিকার যেমন প্রার্থীর আছে, কিন্তু ভোট দেওয়ার অধিকারও জনগণের। এখানে কেউ কারো উপর বলপ্রয়োগ করার চেষ্টা করবেন না। আর নিজেদের মধ্যে কেউ দ্বন্দ্ব করলে কেউ রেহাই পাবেন না। এটা মাথায় রাখতে হবে। আর জনগণ ভোট দেবে তাদের সেই ভোট দেওয়ার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। ভোট কেন্দ্রে আসতে দিতে হবে এবং যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় সেই ব্যবস্থাটা সবাইকে নিতে হবে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে যাতে বিদেশি পর্যবেক্ষক না আসে সেবিষয়ে দেশে-বিদেশে অনেক চেষ্টা করা হলেও আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান গুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এসেছে। বিদেশি ১২৭ জন পর্যবেক্ষক ও ৫৯ জন সাংবাদিককে অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। পর্যবেক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের (আইআরআই ও এনডিআই), সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরাম (এসএডিএফ), দক্ষিণ কোরিয়া (এইচএল গ্রুপ), যুক্তরাজ্যের (বি স্ট্রাটেজিক পার্টনার), জাপানের (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন, মুতাশ ক্রিয়েট রিসার্চ), ভারতের (ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম), অস্ট্রেলিয়া, পোলান্ড, নেপালসহ বিশ্বের খ্যাতনামা পর্যবেক্ষক সংস্থা গুলো। এছাড়া বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, চায়না গ্লোবাল টিভি, জাপানের ব্রডকাস্টিং করপোরেশন, ভারতের সকল জনপ্রিয় গণমাধ্যম সহ বিশ্বের সেরা গণমাধ্যম গুলো পর্যবেক্ষণ করছে। এছাড়া নির্বাচনে দেশের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ৪০ টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয় ভাবে ৮৪ টি সংস্থার ২০২৫৬ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) গ্রহনযোগ্য ও অংশগ্রহণ নির্বাচন নিয়ে তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, কোনো নির্বাচন প্রকৃয়াই শতভাগ সফল নয়। সব জায়গায় উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। তারপর কিছু সার্বজনীন বিষয় আছে। যেমন:ভোটারদের ঠিক মতো ভোট নিশ্চিত করা, প্রার্থীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ, নির্বিঘ্নে প্রচারণার সুযোগ, পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রবেশের অধিকার, সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমান সুযোগ, ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের এজেন্টের সামনে ভোট গণনা এসব বিষয় করা গেলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ হয়েছে বলে মনে করা হয়।
নির্বাচনকে নিয়ে বিএনপির ষড়যন্ত্র থেমে নেই। অসহযোগ আন্দোলনে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আন্দোলনে জনসমর্থন নেই। তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে পশ্চিমা বন্ধুরাও নীরবতা অবলম্বন করে আছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের নামে জ্বালাও পোড়াও কয়েকশো সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। আবার ২০১৮ সালে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে অংশগ্রহণ করেছে। আর এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে। এদের সাথে যুক্ত দেশের একশ্রেণির সুশীল নামধারী ব্যক্তি ও পশ্চিমা কিছু রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। কিন্তু দেশের মানুষ শেখ হাসিনার সাথে আছে। মানুষ চায় শান্তি, উন্নতি আর অগ্রগতি। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে উৎসবমূখর ভোটে গণতন্ত্র বিজয়ী হবে, পরাজিত হবে ষড়যন্ত্র।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই