Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্বাচন: কার মান কার দণ্ড!

মোস্তফা কামাল
১২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৪৩

এবারের নির্বাচনটির গুণমান-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য-ধরন বা মডেল নিয়ে আলোচনা শিগগিরই শেষ হবার নয়। প্রথমত. স্থানিকভাবে বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে এবারেরটির তুলনা চলে না। দ্বিতীয়ত. আন্তর্জাতিকভাবে এক ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি। তৃতীয়ত. এ বছর বিশ্বের আরো অনেক দেশেই নির্বাচন। ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ দিয়ে শুরু হলো মাত্র। ডিসেম্বর পর্যন্ত ওইসব নির্বাচন শেষ হওয়ার পর মোটাদাগে বিচার বা তুলনা করা যাবে কেমন হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনটি।

বিশ্বব্যাপী রাজনীতি-কূটনীতির এমন কি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পর্যন্ত পাল্টে গেছে। শত্রু-মিত্রের উদাহরণও বদলে গেছে। গতকালের শত্রু আজ বন্ধু। আবার বন্ধুই শত্রু। চলমান এ স্নায়ুযুদ্ধকালে সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি মাঝে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বের অন্তত ২৭টি দেশে ছোটবড় সমর যুদ্ধের ঢোল-তবলার মধ্যে এ বছর বাংলাদেশসহ ৩০-৩১টি দেশে নির্বাচন। ভোগলিক আয়তন বিচারে এ ভোটযুদ্ধ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জুড়ে।

আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান বিশ্বে নির্বাচনের ধরন ভিন্ন। ভোট আর যুদ্ধ এখন শুধু সমরাস্ত্রের নয়, তা চলে অর্থনীতিতে, প্রযুক্তিতেও। ভোট বা যুদ্ধের কিছু ক্রিয়া-বিক্রিয়া চোখেও দেখা যায় না। বুঝে নিতে হয়। বাংলাদেশেও এর কিছু দৃশ্যায়ণ স্পষ্ট। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পরদিন সকাল হতে না হতেই গণভবনে ছুটে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয় ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের মাঝে। এ দৌড়ে ফার্স্ট হন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে তিনি কেবল অভিনন্দনই জানাননি। বন্ধুত্বকে এগিয়ে নেয়া, পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো এবং সহযোগিতাকে আরও গভীর করতে চীন শেখ হাসিনার সরকারের সাথে কাজ করবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত । এও বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ রুখে দিতে পাশে থাকবে চীন। চীনের রাষ্ট্রদূতের পর ঢল নামে অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের। রীতিমতো এলাহীকাণ্ড। ভারত, রাশিয়া, ভূটান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত ছুটে যান গণভবনে। মরক্কোর রাষ্ট্রদূত ও ডিন অব দ্যা ডিপ্লোমেটিক কোরও বাদ যানি। গণভবনে যাওয়ার দৌড়ে শামিল হয়েছেন আগা খান ডিপ্লোমেটিক রিপ্রেজেনটেটিভের প্রতিনিধিরাও । তারা নিজ নিজ দেশের সহযোগিতা উজাড় করে দেয়ার কথা জানান।

এ ধারার বাইরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হয়নি বলছে তারা। তবে, নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন বা নির্বাচনকে অবৈধ বলেনি। বরং সম্পর্ক ও উন্নয়ন সহযোগিতা বাড়ানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। এটাই কূটনৈতিক বাস্তবতা। এ বাস্তবতার মাঝে নির্বাচন নিয়ে কে কী বললো সেদিকে একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই প্রধানমন্ত্রীর। যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়ার দিন ৮ জানুয়ারি বিকালেই তিনি গণভবনে ‘বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক সম্মেলনে’ সাফ বলে দিয়েছেন, বিরোধী দল না থাকলেও গণতন্ত্র থাকতে পারে, বাংলাদেশেও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের মান কি বাংলাদেশের চেয়ে ভালো- যুক্তরাষ্ট্রেরই এক পর্যবেক্ষককে এ প্রশ্ন ছুঁড়ে মাত করে দেন প্রধানমন্ত্রী।

এবারের নির্বাচনের আগে থেকেই জানানো হয়েছিল-মিনিমাম ডেমোক্রেসি, ম্যাক্সিমাম ডেভলপমেন্টের কথা। বাংলাদেশ ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির গণতন্ত্র অনুসরণের বার্তাও দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের মডেল একেক দেশে একক রকম –এ কথাও ক’দিন আগে বেশ দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে এবার ভিন্ন মডেলের নির্বাচনের বার্তাও দিয়ে রেখেছিলেন। কেবল অপজিশন নয়, তার নিজ দলের অনেকেও এ বার্তার রহস্য বুঝে উঠতে পারেননি। অথবা বাতকে বাত রাজনৈতিক কথার মতোই ভেবেছিলেন। এখন সবাই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন নয়া মডেলের রকমফের। মানি না, মানি না বললেও কী মানেন না- তা বলতে পারছে না, বোঝাতেও পারছে না অপজিশন থেকে। রাতের ভোট, বিনাভোট, হাঁ-না ভোট কোনো বাহানাই দেয়া যাচ্ছে না। নানা কারণে ও অভিযোগের জেরে নির্বাচনের সঙ্গে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য, পিউর, খাঁটি, অরজিনাল, হালালসহ নানা বিশেষণ যোগ হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি শব্দই আপেক্ষিক। কোনটা কার কাছে অগ্রহণযোগ্য-গ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতিত্ব বা নিরেপেক্ষ তা একেবারেই যার যার মতো। আবার অংশগ্রহণমূলকের মাঝেও বহু ফ্যারকা। দলের অংশগ্রহণ না প্রার্থীর অংশগ্রহণ, ভোটারের অংশগ্রহণ না পর্যক্ষেকদের অংশগ্রহণ? তা নিয়েও এন্তার মতামত-অভিমত।

এতো কিছুর মাঝেও মানদণ্ডের একটি বিষয় রয়েছে। কার মান কার দণ্ড দিয়ে মাপা হবে এটি কঠিন প্রশ্ন। পরিমাপের সময় পাল্লা কার, বাটখারা কার, দেখা হবে কার চশমা দিয়ে, সময় ঠিক করা হবে কার ঘড়ির কাঁটায়-এসব বিষয়আসয়ও রয়েছে। এ রকম অবস্থায় চলতি বছর বিশ্বের অন্তত ৩০-৩১টি দেশে নির্বাচন। মানদণ্ড, গ্রহণযোগ্যতার ছবক দেয়া বিশ্বের টপ সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম চতুর্বার্ষিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এ বছরের শেষদিকে ৫ নভেম্বর। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন এরই মধ্যে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখা শুরু করেছে।

রাশিয়ায় আসন্ন নির্বাচনে পুতিন স্বতন্ত্র নির্বাচনে জেতার মধ্য দিয়ে আর কোনো দলের না হয়ে সবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। প্রতিবেশী ভারতেও নির্বাচন আসন্ন। এপ্রিল-মে মাসে দেশটির প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ তাদের নেতা নির্বাচনে ভোট দেবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করছে। নির্বাচনের কানাঘুষা পাকিস্তানেও। মধ্য জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪০ কোটির বেশি মানুষ ভোট দেবেন। বিভিন্ন ইস্যুতে চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকা এই জোট নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। জুনে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এ বছরই নির্বাচন। একদিকে দেশে দেশে ভোট, আরেকদিকে যুদ্ধ- এই রসায়ন বিশ্বকে কোথায় নেবে উদ্বেগ আছে অনেকের। তারওপর নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিয়ে বাহাসের কচলানি চলছে এসব দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের মধ্যে।

গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সুরক্ষায় বিভিন্ন প্রটোকল, ঘোষণা, চুক্তি এবং নানা ধরণের আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির আলোকে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণ হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের কমিটি মানবাধিকার, ভোটাধিকার এবং নির্বাচন সংক্রান্ত একটি ঘোষণা গ্রহণ করেছে। নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেখানে ২৫ টি বিষয় গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর নানা দেশে নির্বাচনের নানা পদ্ধতি রয়েছে। তাদের একেক দেশে নির্বাচনের একেক মডেল। প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন। এরপরও কিছু কমন মানদণ্ড রয়েছে। জাতিসংঘের দেয়া মানদণ্ড সেখানে আটটি। এর কিছু সর্বজনীন । আর কিছু নির্দেশিকার মাধ্যমে নির্ধারিত। আটটি মানদণ্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রভাবমুক্ত, নির্বিঘ্ন প্রচারণা, স্বাধীন পর্যবেক্ষক , গণমাধ্যমে সমান সুযোগ, স্বাধীন সংস্থা, ভয়ভীতিমুক্ত ভোটদান, অর্থের প্রলোভন বা অযাচিত প্রভাব না থাকা এবং প্রতিহিংসার শিকার না হওয়ার কথা বলা হয়েছে বিশেষভাবে। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে উগান্ডা-রুয়ান্ডা পর্যন্ত কোথাও কোথাও এগুলোর একটিও বাস্বাস্তবায়ন হয় না। কোথাও কোথাও কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এমন এক রসায়নের মধ্যেই হয়েছে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি আছে। থাকাই স্বাভাবিক। কমনওয়েলথ, ওআইসি, রাশিয়া, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়াসহ বিভিন্ন বিদেশি পর্যবেক্ষক দল সংবাদ সন্মেলন করে বলেছে, সারাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। পর্যবেক্ষক হিসেবে সহিংসতার কোনো চিহ্ন তাদের চোখে পড়েনি।

এসময় ফিলিস্তিনি নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান হিশাম কুহাইল বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে। ভোট দেওয়া না দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি ওআইসির নির্বাচন ইউনিটের প্রধান শেখ মোহাম্মদ বন্দর। ভোট তুলনামূলক কম পড়ার বিষয়ে তার এমন সাবধানী অবস্থান। তার জায়গায় তিনি ঠিকই আছেন। দেশের বিরোধীমহলের কাছে এসব প্রতিক্রিয়া ভালো মনে হয়নি। তাদের পছন্দ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের প্রতিক্রিয়া। তাদের বিশেষ করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার মাঝে যে নমনীয়তা রয়েছে সেদিকটির দিকে নজর যায়নি কারো কারো। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ’অবাধ ও মুক্ত ভারত -প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠন, মানবাধিকার ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে’ যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী বলে নির্বাচন নিয়ে দেওয়া তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যার সারাংশ হচ্ছে, ইন্দো প্যাসিফিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করতে চায়। এ প্রতিক্রিয়া তাদের নির্বাচনের আগের অবস্থানের তুলনায় নমনীয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এজেডএস

নির্বাচন: কার মান কার দণ্ড! মোস্তফা কামাল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ভূতের গলির বাসায় মিলল বৃদ্ধের মরদেহ
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:০০

সম্পর্কিত খবর