মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতিতে কি আভাস মিললো?
১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:১৯
প্রতিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামীলীগ জাতির সামনে বিভিন্ন অঙ্গিকার করে এবং উন্নয়নের রুপরেখা জানিয়ে ইশতেহার প্রকাশ করে। এবারও তারা দেশকে এগিয়ে নেয়ার এবং জনকল্যাণের লক্ষ্যে একটি ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এই ইশতেহারে আস্থা রেখে জনগণ বিপুল ভোটে আওয়ামীলীগকে টানা চতুর্থ এবং পঞ্চমবারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। অতীতে দেখা গেছে ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামীলীগ সরকারের প্রচেষ্ঠা ছিল প্রতিবারই। ইশতেহারের প্রায় সব অঙ্গিকারই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবার কি হবে? তারা কি জাতিকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সফল হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য যাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন, যাদের নিয়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেছেন সেই মন্ত্রীরা কি করবেন? প্রথম দিন মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের কাছে তারা যা বললেন তা থেকে কোন ইঙ্গিত কি মিললো?
দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনমনে বেশ অস্বস্তি আছে। মানুষ কষ্টে আছে। অর্থ পাচারের কাহিনী শুনে শুনে অনেকেই ক্ষুদ্ধ্ব। নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দায়িত্ব নিয়েই বললেন পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। জানান অর্থ পাচার রোধে কাজ করা হবে। টাকার মূল্য কমে কমে গেছে। এ নিয়েও কাজ করা হবে।
দেশের খাদ্যমূল্য বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটের বড় ভূমিকা থাকে, তারাই মানুষের কষ্টের নাটের গুরু,বাজারের অস্থিরতার সব কলকাঠি তারাই নাড়ে -এ ধারণা সবারই। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আগে কিছু করা যায়নি। আগের বাণিজ্য মন্ত্রী এই প্রবল প্রতাপশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু “দেশে সিন্ডিকেট আর থাকবেনা:- দায়িত্ব নিয়েই এমন হুশিয়ারি দিয়েছেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। প্রতিমন্ত্রী বলেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন, টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে যখন যাকে দরকার তাকেই মাঠে নামানো হবে। বর্তমান কাঠামো ঢেলে সাজিয়ে একটি স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। জুনের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করা হবে। পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, এবং মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নিয়ে সমন্বয় টিম গঠন করা হবে। জানান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাকে স্পষ্ঠ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি আরো জানান এ জন্য সংশ্লিষ্ঠ অধিদপ্তরগুলোকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
দুর্নীতি নিয়ে অনেক অভিযোগ শোণা যায়। বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে অনেক গল্প ছড়ায়। নতুন পরিকল্পনা মন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম জানান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন ছাড় দেয়া হবে না। বলেন এটি এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। তিনি জানান স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রকল্পগুলোর দিকে এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নের দিকে তিনি নজর দিবেন। জানান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দুর্নীতি নিরসনে যে সংগ্রাম ও যুদ্ধ তিনি সে যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন আপোষ করা হবে না।
স্বাস্থ্যখাতে অভাব-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক পুরনো। কারোর সেটি অজানা নয়। ব্যাক্তিগতভাবে ক্লিন ইমেজের স্বনামধন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা, সামন্ত লাল সেনকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি রোধে কোন ধরণের ছাড় দেয়া হবেনা। জানান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে তার কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছেন কঠোর ব্যবস্থা নিতে এবং কোন সমস্যা হলে তাঁকে জানাতে।
ভুমি অফিসগুলোর হয়রানি ও দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেছেন এই হযরানি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থান নিবেন। মন্ত্রণালয় ও তার বিভিন্ন অধিদপ্তরের সবাইকে নিয়ে তিনি পরিচ্ছন্নভাবে কাজ করবেন। সবকিছু ডিজিটালাইজ করা হবে তাহলে দুর্নীতিবাজরা সুযোগ আর পাবে না। তিনি জানান প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পিত ইশতেহারের স্মার্ট ভুমি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে তিনি কাজ করবেন। এজন্য সব অংশীজনের সহযোগিতা চান তিনি।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কিছুটা টানাপোড়ান সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর পুর্ব-পশ্চিম সব দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানিয়েছে। নতুন পররাস্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দায়িত্ন নিয়েই জানান পুর্ব-পশ্চিম সব দেশকেই নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। জানান ৫২ বছরে বাংলাদেশের যে অর্জন তাতে উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতা ছিল। বলেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের উদ্বেগকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের একটি বড় ইস্যু পরিবেশ দুষণ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন পরিবেশের কোন অনিয়ম মানা হবে না। বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক কর্মকান্ড অন্তর্ভূক্ত করে ১০০দিনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তিনি। তিন বলেন বায়ুদুষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, প্লাস্টিক ও পলিথিলিনদূষণ,পাহাড় কাটা, নদী-খাল ভরাট করা বন্ধ করতে অংশীজনদের পরামর্শ নিয়ে সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। টেকসই উন্নয়ন ও বন দখল রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের যে অভিযাত্রা চলছে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও আসন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে। এর মূল্যায়ন নিয়ে অনেক আলোচনা -সমালোচনা হচ্ছে। নতুন শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরি নওফেল জানিয়েছেন সবে এটি চালু হচ্ছে।কোন দূর্বলতা থাকলে , সমস্যা থাকলে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার সমাধান করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী জানান স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট সিটিজেন লাগবে। আর স্মার্ট সিটিজেন গড়তে প্রয়োজন স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেম। সেই লক্ষ্যেই কাজ করবেন তিনি ও তার মন্ত্রণালয়।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের আবাধ প্রবাহ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যহার করে গোষ্ঠির গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর অপতৎপরতা জবাবদিহিতার আওতায় আনা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন নুতন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত । তিন বলেন তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। আওয়ামীলীগ সরকার এটি নিশ্চিত করেছে। দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়েনর স্বার্থে তা অব্যাহত রাখতে চান তথ্য প্রতিমন্ত্রী। বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে তথ্যের আবাধ প্রবাহ কীভাবে আরও সুন্দর করা যায় সে ব্যাপারে তিনি কাজ করবেন।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি অন্যতম মাধ্যম অভিবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।বাংলাদেশের প্রায় সোয়াকোটি মানুষ অভিবাসী। এদের অধিকাংশই অদক্ষ কর্মী। ফলে অভিবাসীর সংখ্যার তুলনায় রেমিটেন্সের পরিমাণ অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। কিন্তু দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠাতে পারলে রেমিটেন্সের অংক বহুগূণ বেড়ে যেতে পারে। নতুন প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান এদিকেই নজর দিতে চান। তিনি বলেছেন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে অধিক সংখ্যায় কর্মী বিদেশে পাঠিয়ে রেমিটেন্স বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। জানান সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে অভিবাসনখাতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করবেন তিনি।
বাংলাদেশের রপ্তানী আয় তৈরি পোষাকপণ্যের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু রপ্তানী আয় বাড়াতে বহুমুখী পণ্য রপ্তানীর দিকে নজর দেয়া জরুরী। নতুন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জানিয়েছেন বহুমুখী পাটজাত পণ্যের রপ্তানী বাড়াতে কার্যকরী উদ্যোগ নিবেন। বলেন,পাট খাতের সমৃদ্ধি অর্জনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন তিনি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন বিমানের যাত্রীসেবা ও লাগেজ হ্যান্ডলিং কীভাবে আরো উন্নত করা যায় , কীভাবে আরও নতুন নতুন গন্তব্যে বিমান যেতে পারে যে ব্যাপারে চেষ্টা করবেন। জানান এভিয়েশন খাতে অনেক উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। তার কাজ হবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে সে কাজগুলো সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ফারুক খান জানান বাংলাদেশ পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দেশ। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দেশে পরিবেশ বান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানের নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র তৈরীর লক্ষ্যে কাজ করবেন তিনি। জানান বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাজ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে ভিশন তার একটি রুপরেখা হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ইশতেহার। এই ভিশন বাস্তবায়নের জন্য দরকার স্মার্ট মানসিকতা, স্মার্ট উদ্যোগ, স্মার্ট নেতৃত্ব। কথায় আছে মর্নিং শোজ দ্য ডে। নুতন মন্ত্রী পরিষদের মন্ত্রীদের কাজ শুরুর প্রথম দিনে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে কি তার কোন আভাস পাওয়া গেল?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
মত-দ্বিমত মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতিতে কি আভাস মিললো? মাহমুদুল হাসান শামীম