চিনির বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে
১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৩৬
চিনি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। এখন পর্যন্ত দেশে ১৫টি চিনি শিল্প কারখানা (সুগার মিলস) রয়েছে- যা সুগার এন্ড ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন কর্কৃক প্রসাশনিকভাবে পরিচালিত। যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১লা জুলাই, ১৯৭৬ সালে। এফ.এ.ও এর তত্ত্ব মতে প্রতিদিন প্রতিজনে মাথাপিছু চিনির প্রয়োজন হয় ২৯ গ্রাম এবং এই চাহিদা পূরনের জন্য বাংলাদেশে বার্ষিক ১ থেকে ১.২ মিলিয়ন টন চিনির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে চিনির কলগুলোর বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ০.২১ মিলিয়ন টন যা প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ মিটিয়ে খাকে এবং বাকি ৮০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরন হয়ে থাকে। রাষ্টায়ত্ত চিনির কলগুলোতে উৎপাদন কম হওয়ার কারন অন্যতম হলো মানসম্মত আখ সরবরাহ না হওয়া যা থেকে কম চিনির রস তথা চিনি আহরিত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলো এক সময় বছরে দেড়-দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত। কিন্তু গত দুই বছরে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলের মধ্যে ৬টির উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশীয় উৎপাদন কমে ৩০ হাজার টনে নেমে এসেছে। এ কারণে দেশের চিনি খাত প্রায় শতভাগ আমদানিভিত্তিক বেসরকারি চিনিকলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে এই পণ্যের বাজারে সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাছাড়াও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, আর্থিক দৈন্যতা, নিম্নমানের আখ সরবরাহ, পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও কারখানা পর্যায়ে দুর্ণীতি সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে গেছে।
সাম্প্র্তিককালে আখ চাষে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এবং কৃষকরা আরও লাভজনক ফসলের দিকে ধাবিত হওয়ায় চিনি কলগুলো আখ মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ পায় না এবং আখ সরবরাহকারি চাষীরা মিলের কাছ থেকে সময়মত তাদের বিক্রিত মূল্য পায়না। চিনি কল কর্তৃপক্ষ যে পদ্ধতিতে চাষীদের কাছ থেকে আখ ক্রয় করে থাকে তাতে অনেক সময় চাষীরা প্রতারিত হয়ে থাকে বলে খবর প্ওয়া যায়।
এই সকল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যা থাকলেও সরকার চাইছে সকল সমস্যার সমাধান করে চিনিতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হউক এবং রপ্তাণীমূলক শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হউক। এরি মধ্যে ইশ্বরদীতে অবস্থিত ইক্ষু গবেষনা ইনষ্টিটিউট নূতন জাত ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে রয়েছে উচ্চ ফলনশীল জাত, শষ্য বিন্যাস, চাষ পদ্ধতির আধুনিকায়ন ইত্যাদি। তাছাড়াও নদীর চর, পাহাড়ি এলাকা, লবনাক্ত জমি ইত্যাদিতেও আখ চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারনের কাজ চলছে।
ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য- আখে চিনির পরিমাণ ১২ শতাংশের কম থাকে না। কারখানাগুলোতে চিনি লস বেশি হওয়ার কারণেই আহরণের হার কম। কারখানাগুলো এই লস অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে দেখার জন্য ব্যাক ক্যালকুলেশন করে আখের চিনির হার কম দেখায়! আখে চিনির হার কম হওয়ার আরেকটি কারণ, অঞ্চলভেদে মাটির বৈশিষ্ট্য, জমির উচ্চতা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত জাতের আখ চাষ যথাযথভাবে না হওয়া। আবার আখে চিনি থাকলেও সময়মতো পরিবহন করতে না পারার কারণে বা কারখানায় নেওয়ার পরসময়মতো মাড়াই না হওয়ার কারণে আখ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ চিনি আহরণ করা যায় না। অন্যদিকে আখে চিনি থাকলেও কারখানায় প্রসেসিংয়ের সময় আখ থেকে চিনি কমআহরণ হওয়ার কারণ- আখ মাড়াই করে রস বের করার যন্ত্র (রোলার) ঠিকঠাক কাজ না করা; মেয়াদোত্তীর্ণ, নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার; কোনো যন্ত্র হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আহরিত রসটুকু নষ্ট হওয়া; রস প্রক্রিয়াজাত করার সময় রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্র ব্যবহারের কারণে শুধু যে চিনি কম আহরিত হচ্ছে, তাই নয়; সেই সঙ্গে প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আখ মাড়াইকালে সময়ের অপচয় ইত্যাদিও বেশি হচ্ছে। যার ফলে চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে অন্যান্য পন্যের মতো চিনির বাজারেও অস্থিরতা চলছে যা অসহনীয় এবং এর কারণ হিসাবে অনেকেই সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ি করছে। আবার কেহ কেহ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফাকে দায়ি করছে, যার একটি গ্রহনযোগ্য বিশ্লেষন প্রয়োজন, যা এই প্রবন্ধের মুল উদ্দেশ্য।
উদাহরণস্বরূপ:
এক: সরকার চিনির দাম বেধে দিলেও বাজারে তারকোন প্রতিফলন নেই যার বহিঃপ্রকাশ প্রতি কেজি বাজার ভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রির রেকর্ড রয়েছে যদিও এর আগের মূল্য রেকর্ড ছিল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত। বিভিন্ন কম্পানি ট্রাকে করে ৯৫ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি করলেও সরকারী সংস্থাটি চিনি বিক্রি করছে ৫৫ টাকা প্রতি কেজিতে। এই অস্থিরতার পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস ইত্যাদির কথা বলা হলেও মূল কারণ বেসরকারি আমদানিকারকদের ওপর একক নির্ভরশীলতা। যার ফলে এই পণ্যের বাজারে সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই;
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় চিনি কলগুলোর থেকে চিনির উৎপাদন খরচ আমদানি করা চিনির বাজার দরের তুলনায় অনেক বেশি যার কারন বিশ্লেসন করলে দেখা যায় চিনি কলগুলো সারা বছর মাড়াইয়ের মতো পর্যাপ্ত আখ পায় না বলে বছরের বড় সময় জুড়ে বন্ধ থাকে যদিও বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থির খরচ সারা বছরই বহন করতে হয়; মাড়াই করার জন্য যে আখ পাওয়া যায়, তা থেকে চিনি আহরণের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম – ৬ থেকে ৭ শতাংশ যা ভারত বা ব্রাজিলে এই হার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। ফলে টন প্রতি আখ থেকে চিনি উৎপাদন হয় কম, আবার চিনি উৎপাদনে ব্যয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ হয় কাঁচামাল বাবদ। চিনি আহরণের অতি নিম্ন হারের কারণে বাংলাদেশে চিনি কলগুলোর কাঁচামাল বাবদ খরচ ভারতীয় চিনি কলগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ, যা প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হয়;
তৃতীয়ত: চাষাবাদ ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকটের কারণে বাংলাদেশে একর প্রতি আখের ফলন গড়ে ১৮-১৯ টন যা ভারতে একর প্রতি গড় আখ উৎপাদন ২৮ টন। তাছাড়াও সময়মত আখ বিক্রি করা যায়না, বিক্রি করলেও সময়মতো অর্থ পাওয়া যায় না যার ফলে কৃষকরা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষ করছেন, খরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায় না; চিনি কলে সময়মতো বিক্রি করতে না পারায় তারা চিনি কলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রি করছেন;
চতুর্থত: বাংলাদেশের চিনি কলগুলোয় আখ থেকে চিনি আহরণের হার এত কম হওয়ার কারন হিসাবে চিনি কল কর্তৃপক্ষ বলছে, কৃষকদের কাছ থেকে কেনা আখের চিনি ধারণ ক্ষমতা ৮ থেকে ৯ শতাংশ যার ফলে ২.৩৫ থেকে ২.৪০ শতাংশ কারখানা লোকসান বাদ দিলে কার্যকর চিনি আহরণের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই;
পঞ্চমত: আমদানিনির্ভর অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের মতো চিনির বাজারেও চলছে অস্থিরতা অথচ সময়মত গুরুত্ব দেওয়া হলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলো দেশে চিনির চাহিদার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা যেত। সেই সঙ্গে হাজারো আখ চাষি ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো;
ষষ্ঠত: সাম্প্রতিক ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশীয় উৎপাদনের গুরুত্ব যেভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প পুনরুজ্জীবনে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার এটাই প্রকৃষ্ঠ সময় বলে প্রতিয়মান হয়। এ ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন করা প্রয়োজন বিশেষত উৎপাদন প্রকৃয়ার সাথে যুক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে।
আরও একটি বিষয় রযেছে। আরতা হলো স্থানীয়ভাবে উ্ৎপাদনকারীর মূল্যের সাথে আমদানি হওয়া চিনির মূল্যেও সমতা বিধান যা সরকারের একক দায়িত্ব বিধায় স্বানীয় চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই