Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারত-মালদ্বীপ: ঐতিহাসিক বন্ধু কেন হঠাৎ শত্রু?

সন্দীপন বসু
১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:১৫

৬০ বছরের দীর্ঘ বন্ধুত্ব। ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের অবিচ্ছেদ্য উন্নয়ন অংশীদার। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে মালদ্বীপের। কিন্তু হঠাৎ কী হলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী এই দুই দেশের সম্পর্কে? দেশটি কেনইবা ভারতবিদ্বেষী হয়ে উঠল! কেনইবা ভারতের জনগণ গণহারে মালদ্বীপ বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছে!

অনেকেই বলছেন নেপাল, শ্রীলংকার পর এবার মালদ্বীপে চীনের কাছে ভারতের কূটনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। অনেকে আবার বলছেন, শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়া গতি নেই মালদ্বীপের। বিশ্লেষকদের মত, ভারত-মালদ্বীপ চরম উত্তেজনার মধ্যে দূরে বসে ঘি ঢালছে চীন। অনেকেই আবার ভারতীয়দের মালদ্বীপ বয়কটের পেছনে চীনের ষড়যন্ত্র দেখছেন।

মোদির এক ছবিতেই বদলে গেল ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক

দৃশ্যত ঘটনাটি শুরু হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কয়েকটি আপাত ‘নির্দোষ’ ছবি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। চলতি বছরের শুরুতে ভারতের কেন্দ্রশাসিত লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণে গিয়েছিলেন মোদি। ছোট বড় ৩৬টি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে আরব সাগরে এই লাক্ষাদ্বীপের অবস্থান। যা ভারতের মূলভূমি থেকে প্রায় সাড়ে তেরশ কিলোমিটার দূরে। লাক্ষাদ্বীপ থেকে মালদ্বীপ আরও ৭৫০ কিলোমিটার দূরে।

লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নীল জলরাশি আর ধবধবে সাদা বালুতে নিজের বেশ কয়েকটি নয়নমনোহর ছবি পোস্ট করেন। লাক্ষাদ্বীপের দারুণ সুন্দর পরিবেশে মোদির স্নরকেলিং, সাদাবালিতে ঘুরে বেড়ানো বা বিশাল নীল সৈকতে বিশ্রাম নেওয়ার ছবিগুলো যেন হার মানিয়েছিল হরহামেশাই মালদ্বীপ ভ্রমণে যাওয়া বলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও। স্বাভাবিকভাবেই ছবিগুলোর নিচে কমেন্টের ঢল নামে। অনেকেই আলোচনা করতে থাকেন ছুটি উদযাপনে মালদ্বীপ না গিয়ে বরং লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জে যাওয়া উচিত। এরপরে আরেকটি পোস্টে মোদিও তার দেশের ‘অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়’ জনগণকে অপূর্ব সুন্দর লাক্ষাদ্বীপে বেড়াতে যেতে পরামর্শ দেন। সাথে সাথেই নেট দুনিয়ায় নতুন ‘ট্রেন্ডিং’ বিষয়ে পরিণত হয় লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণ। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখতে শুরু করেন- তারা মালদ্বীপ ছেড়ে লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর এ পরামর্শের পর দেশটির পর্যটন বিভাগ লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরে তাদের কিছু পরিকল্পনার কথা জানায়। জানা যায়, টাটা গ্রুপসহ ভারতের কিছু বিখ্যাত শিল্পগ্রুপ ইতোমধ্যে লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন সম্প্রসারণে পরিকল্পনা করছে। এছাড়া ইসরায়েলের একটি সংস্থা দ্বীপটিতে সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তি স্থানান্তরের কাজ করছে বলেও জানা যায়। ভারতের পর্যটন বিভাগ আরও জানায়, খুব দ্রুত লাক্ষাদ্বীপে নির্মাণ করা হচ্ছে বিমানবন্দর। যা ভারতের এই দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনার বাইরেও প্রশান্ত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।
দৃশ্যত এইটুকু পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায়, যখন মোদির টুইটটি রিটুইট করে মালদ্বীপের একজন মন্ত্রী লিখেন- ‘মোদি একজন ভাঁড় এবং তিনি ইসরায়েলের ক্ষমতায় ক্ষমতাশালী হয়ে ভারত শাসন করছেন।’

মোদিকে নিয়ে কেন কুৎসিত মন্তব্য মালদ্বীপ মন্ত্রীর?

উল্লেখ্য, মালদ্বীপ সরকারের অন্তত তিন মন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করেছেন। এদের মধ্যে উপমন্ত্রী মরিয়ম শিওনা এক্সে মোদিকে ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে জড়িয়ে মন্তব্য করেন। প্রায় একইরকম মন্তব্য করেন দেশটির আরও দুই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও উপমন্ত্রী মালশা শরীফ ও আবদুল্লাহ মাহজুন মজিদ। তাদের সবার বক্তব্যেই মালদ্বীপে ভারতীয় সেনাদের অবস্থানের বিষয়টি উঠে আসে। তারা বক্তব্যে স্পষ্ট করেন, দেশটিতে ভারতীয় সেনাদের অবস্থানের পেছনে তাদের সরকারের জোর আপত্তি রয়েছে।

কিন্তু কেন প্রতিবেশী শক্তিশালী একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কূরুচিপূর্ণ মন্তব্য করলেন মালদ্বীপের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা? মালদ্বীপের সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য, পর্যটননির্ভর মালদ্বীপের নেতারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় চরম আঘাত পেয়েছেন। তারা ভাবছেন ভারতীয়রা তাদের প্রধানমন্ত্রীর কথামতো মালদ্বীপ ভ্রমণ বাদ দিলে দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আর তারই ফলাফল এই ‘হঠকারী’ কূরুচিপূর্ণ মন্তব্য।

এদিকে, এমন মন্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দিল্লিতে মালদ্বীপের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছে। কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অন্য দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত এই কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা করেছে। এদিকে মালদ্বীপও স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা এ ধরনের মন্তব্য স্বীকার করে না। সরকারের উর্দ্ধতন ব্যক্তিদের এহেন টুইটের প্রতিবাদ জানান দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সালেহও। পরিস্থিতি সামলাতে একপর্যায়ে মালদ্বীপ সরকার তাদের মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্য দেশটির সরকারের বক্তব্যকে প্রতিনিধিত্ব করে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগে মালদ্বীপ সরকার তাদের তিন উপমন্ত্রী মরিয়ম শিওনা, মালশা শরীফ ও আবদুল্লাহ মাহজুন মজিদকে বরখাস্তের কথাও জানায়।

তবে মোদিকে নিয়ে কটুক্তি ও ভারতীয়দের মালদ্বীপ বর্জনের পুরো প্রক্রিয়াটি এতো সহজ নয়। এর পেছনে রয়েছে ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ করে কেনইবা মালদ্বীপের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বল্প পরিচিত লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জকে জনগণের সামনে নিয়ে এলেন? কেনইবা এমন এক সময়ে ঘোষণাটি দিলেন যখন ভারত-মালদ্বীপের মধ্যে সম্পর্ক শীতলতম! এটা সত্যি যে প্রধানমন্ত্রী তার দেশের যে কোনও পর্যটন স্থানকে জনগণের সামনে তুলে ধরতেই পারেন। কিন্তু সময়টা নিয়েই বেঁধেছে দ্বন্দ্ব।

বহুদিন পর মালদ্বীপে একটি চীনপন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আর দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুর সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশী দুটি দেশের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। মুইজ্জু তার নির্বাচনী প্রচারণায় ‘কুইট ইন্ডিয়া’ স্লোগান দেওয়ার পর ভোটে জিতেও সেই একই নীতি নিয়ে পথ চলছেন।

ভারতে যখন মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়া বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং হয়ে উঠেছিল, সেই সময়ে মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু ছিলেন চীন সফরে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল- নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রথম সফর করতেন ভারতে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু এই প্রথা ভেঙে প্রথম বিদেশ সফর করেন তুরস্কে। সেখান থেকে তিনি পাঁচ দিনের সফরে চীন যান। আর ঠিক সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাক্ষাদ্বীপ সফরে যান। ঠিক পরপরই ভারতে ‘বয়কট মালদ্বীপ’ ট্রেন্ড শুরু হয়। চীন থেকে ফিরেই মোহামেদ মুইজ্জু ঘোষণা দেন- মালদ্বীপ কারও বাড়ির পেছনের উঠান নয় বা মালদ্বীপে বাইরের শক্তির কোনওরূপ হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর অপমানে ভারতীয়দের মালদ্বীপ বয়কট

দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই কুরুচিকর বক্তব্য এই অপমানকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি ভারতের জনগণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে গেছে মালদ্বীপ বর্জনের ঘোষণায়। মালদ্বীপের নেতারা যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করছিল- তখনই পাল্টা প্রতিবাদ করে দেশটির বিভিন্ন সেক্টরের তারকা থেকে শুরু করে দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। বলিউড অভিনেতা অক্ষয় কুমার, সালমান খান, অনিল কাপুর, শ্রদ্ধা কাপুর, ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দ্রর শেওয়াগসহ আরও অনেকেই তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘কুরুচিকর’ মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন। ইতোমধ্যে মালদ্বীপে যে কোনও ধরণের শুটিং বাতিলের কথা জানিয়েছে ভারতের চলচ্চিত্র সংস্থা।

প্রতিবছরই ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ মালদ্বীপে বেড়াতে যান। বলা যায়, ধনী ও মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের ট্যুর ডেস্টিনেশন পছন্দের তালিকায় প্রথমদিকে থাকে দেশটির খুব কাছের এই অনিন্দ্যসুন্দর দ্বীপরাষ্ট্রটি। স্বাভাবিকভাবেই মালদ্বীপে বেড়াতে যাওয়া বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছেন ভারতীয়রা। শুধু ২০২৩ সালেই প্রায় তিন লাখ ভারতীয় মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে দেশটির মন্ত্রীদের অসম্মানজনক মন্তব্যের পর দেশটির পর্যটনে ধস নেমেছে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে এমন পরিস্থিতিতে দেশটির হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। অবস্থা এমন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে যে অনেক হোটেল ৫০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দিয়েও পর্যটকের দেখা পাচ্ছে না।

পর্যটনখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন মোদির একটি পোস্ট এবং তার ফলে মালদ্বীপের মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়ায় কার্যত পর্যটকশূণ্য হয়ে পড়ে মালদ্বীপ। অনেকেই তাদের মালদ্বীপ ভ্রমণ বাতিল করেছেন। এমনকি ভারতের কয়েকটি বিমান সংস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে তাদের উড়ান বাতিল করেছে।

ভারত-মালদ্বীপ: ঐতিহাসিক বন্ধু কেন হঠাৎ শত্রু?

১৯৬৫ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর থেকে মালদ্বীপ বরাবরই ভারতপন্থী দেশ ছিল। ব্রিটিশ মিলিটারি বেইজের তকমা থেকে মালদ্বীপের এই স্বাধীনতার পেছনেও রয়েছে ভারতের অবদান। ভারতই প্রথম স্বীকৃতি দেয় দেশটিকে। পর্যটনের উর্বরভূমি হয়ে ওঠার আগে মালদ্বীপ ছিল মৎসসম্পদনির্ভর একটি দেশ। সেই মালদ্বীপের আমদানি-রপ্তানির অধিকাংশই ছিল ভারতনির্ভর।

স্বাধীনতার পর ৩০ বছর ভারতপন্থী স্বৈরশাসক মামুন আবদুল গাইয়ূম মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মামুন আবদুল গাইয়ূমকে ক্ষমতায় রাখার পেছনে বড় অবদান ছিল ভারতের। দীর্ঘ সময়টিতে দেশটির গণআন্দোলন, মিলিটারি ক্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুনামি সবই একহাতে সামলেছিল ভারত। এরপর ২০০৮ সালে মালদ্বীপে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্পন্ন ও মোহাম্মদ নাশিদের ক্ষমতায় আসার পেছনেও ছিল ভারতের ভূমিকা। মোহাম্মদ নাশিদও ছিলেন ভারতপন্থী। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট নাশিদের আমলেই ভারত সমুদ্র পর্যবেক্ষণের জন্য মালদ্বীপে ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর থেকে ২৬টি রাডার বসিয়ে মালদ্বীপের উপকূলে টহল কার্যক্রম চালাত ভারত।

২০১০ এর দিকে ভারত মহাসাগরে এই দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে চীন। সেই সময়ে চীন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় ব্যাপক ঋণ দেওয়া ও উন্নয়নকাজ চালাচ্ছিল। মালদ্বীপও ২০১২ সালে চীনের দেওয়া ঋণে মালেতে বিমানবন্দর স্থাপন করে। এরপর ২০১৩ সালে গণআন্দোলনে নাশিদ ক্ষমতাচ্যুত হলে ক্ষমতায় আসেন তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহামেদ ওয়াহিদ। ওয়াহিদের ক্ষমতায় আসার পেছনে চীনের ভূমিকা ছিল ওপেন সিক্রেট। অভিযোগ আছে, ওয়াহিদের সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে চীনের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। ওয়াহিদ ক্ষমতায় আসার পর মালদ্বীপে চীনের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু হয়। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়াহিদই প্রথম চীন সফরে যান। তার শাসনামলেই মালদ্বীপ মূলত ভারতবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এরপরের ২০১৩ সালের শেষদিকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও চীনপন্থী আবদুল্লাহ ইয়ামিন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার আমলেই চীনের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শি জিনপিং মালদ্বীপ সফর করেন।

২০১৬ সালে সাহায্য হিসেবে মালদ্বীপের জলপথ সুরক্ষায় ভারত দুটি সামরিক হেলিকপ্টার পাঠায়। ওই হেলিকপ্টারের প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকেও পাঠায় ভারত। সেটি নিয়ে সেসময়ে মালদ্বীপের সরকার আপত্তি জানিয়েছিল। পরে ওই দুটি হেলিকপ্টার ও মালদ্বীপে অবস্থান করা ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে নিতে বলে মালদ্বীপ। একই সময়ে মালদ্বীপের সাগরে চীনের একটি মানমন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা ভারতপন্থী রাজনীতিবিদদের বিরোধিতায় বাতিল হয়ে যায়।

মালদ্বীপে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন ভারতপন্থী নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। এ সময়ে মালদ্বীপে ব্যাপক হারে ঋণ দেওয়া শুরু করে ভারত। সলিহের সময়ে ভারত মালদ্বীপের সঙ্গে সামরিক চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি করে। চুক্তির আওতায় ভারত আবারও মালদ্বীপের উপকূলে টহল দেওয়া শুরু করে। ২০২১ সালে ভারত মালেতে একটি ডকইয়ার্ড তৈরির অনুমতি পায়। এইসময় থেকেই দেশটির ভারতবিরোধীরা প্রচার করেন, ভারত মালদ্বীপে সামরিক ঘাঁটির কাজ শুরু করছে। এই সময়ে থেকে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট চীনপন্থী আবদুল্লাহ ইয়ামিনের ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন দানা বাঁধতে শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে মালেতে ভারতীয় হাই কমিশনের যোগ দিবসের অনুষ্ঠানে একদল বিক্ষোভকারী হামলা করে এবং গোটা অনুষ্ঠান পণ্ড করে। ওইসময়ে তারা ‘ইসলামিক দেশে হিন্দুদের যোগ দিবস’ আয়োজনের বিরোধিতা করে। এরপর থেকেই চীনপন্থী মালদ্বীপের প্রগতিশীল পার্টির প্রচারে প্রাধান্য পায় ‘ভারত ইসলামবিরোধী’ বক্তব্য। এসব বক্তব্যকেই ‘বুলস আই’ করে এগুতে থাকে দলটি। এই ভারতবিরোধীতাই ২০২৩-এর নির্বাচনে চীনপন্থী মালদ্বীপ প্রগ্রেসিভ পার্টির মূল এজেন্ডা হয়ে ওঠে এবং জয় পায় দলটি। নতুন প্রেসিডেন্ট হন মালে সিটি মেয়র মোহামেদ মুইজ্জু।

মালেতে ভারতের একটি রাডার স্টেশন ও সার্ভিলেন্স এয়ারক্রাফট ছিল বহু বছর ধরেই। চুক্তি অনুযায়ী সেখানে ভারতের ৭০ জন সামরিক কর্মী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর এই সেনা সদস্যের উপস্থিতিকে দেশটির সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করে তাদের ভারতে ফিরে যেতে বলেন। এছাড়াও তিনি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ সরকারের আমলে ভারত সরকারের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি স্থগিত করে পুণরায় যাচাইয়ের নির্দেশ দেন। এরপরই মূলত ভারতের সঙ্গে মুইজ্জু সরকারের বিরোধ চরমে পৌঁছে।

মালদ্বীপ নিয়ে চীন-ভারত কেন মরিয়া?

ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে থাকা মালদ্বীপ নিয়ে এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব বহুদিনের। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব খাটাতে মালদ্বীপের অবস্থানটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের ‘ঘরের উঠান’ ভারত মহাসাগরে প্রভাববিস্তার ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথ হিসেবে মালদ্বীপে নিজেদের প্রভাব রাখাটা ভারতের জন্য জরুরী।

দীর্ঘদিন মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি চীন। দ্বীপপুঞ্জটিতে ছিল ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু ২০১৩ সালে চীনপন্থী আবদুল্লাহ ইয়ামিন ক্ষমতায় এলে চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে সম্পৃক্ত হয় মালদ্বীপ। আগে থেকেই ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাববলয় বাড়ানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকা, পাকিস্তান চীনের এই অবকাঠামোগত প্রকল্পে সম্পৃক্ত ছিল। এছাড়া চীন ভারত মহাসাগরে আফ্রিকা ও আরব থেকে তাদের পণ্য পরিবহণের জন্য জলপথ নির্ঝঞ্জাট করার কাজ করছিল। মালদ্বীপের অর্ন্তভুক্তিতে ভারত মহাসাগরের অন্তর্ভূক্ত আরব সাগরে ওমান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ; বঙ্গোপসাগরে শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও দক্ষিণ চীন সাগরে থাইল্যান্ড, কেম্বোডিয়া ও হংকং চীনের এই মহাপরিকল্পনায় শামিল হয়েছিল। যেটা ভারত মহাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ দখল ও ভারতের আধিপত্য কমাতে চীনের এক বড় সাফল্য হিসেবে এখনও বিবেচিত।

ভারতও দীর্ঘকালের এই বন্ধু হারানো এবং ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্যকে সহজে মেনে নেয়নি। কারণ, চীন আফ্রিকার জিবুতি বন্দর থেকে শুরু করে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর, শ্রীলংকার হাম্বানটোটা, মিয়ানমারের রাখাইনে গভীর সমুদ্রব্ন্দর সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে থাইল্যান্ড, কেম্বোডিয়া ও হংকংয়ে চীনের বন্দর ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবই বাড়িয়েছে কেবল। তাই ভারতেরও জোর প্রচেষ্টা থাকছে ভারত মহাসাগরে তাদের ঘরের কাছের বন্ধু মালদ্বীপকে ফিরে পাওয়ার।

এদিকে, আবার ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মাঝে চীনের সঙ্গে সখ্যতা বাড়িয়ে চলছে মালদ্বীপ। সবশেষ সফরে মোহামেদ মুইজ্জু চীনকে মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আখ্যায়িত করে মালদ্বীপে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি চীনা ভ্রমণকারীদের মালদ্বীপ ভ্রমণের আহ্বান জানান। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-ও ঘোষণা দিয়েছেন মালদ্বীপকে সহযোগিতার। ঐতিহাসিকভাবে দুই বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও মালদ্বীপের বৈরিতা এই মূহুর্তে চীনের জন্য একটি বড় সুযোগ। তাই শি জিনপিং ভারতের সঙ্গে দ্বীপরাষ্ট্রটির বৈরিতায় বারবারই মালদ্বীপের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। তবে বেইজিং-মালের হালের এই সম্পর্কন্নোয়ন ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের দূরত্ব আরও বাড়াবে। আর ঘরের পাশের প্রতিবেশীর সঙ্গে এই দূরত্ব এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রে বিলীন হওয়ার আশংকায় থাকা দ্বীপরাষ্ট্রটির ভবিষ্যত কোথায় নিয়ে যায় সেটিই দেখবার।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ভারত-মালদ্বীপ: ঐতিহাসিক বন্ধু কেন হঠাৎ শত্রু? মত-দ্বিমত সন্দীপন বসু


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর