Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পেঁয়াজের উৎপাদন, বাজার মূল্য ও বিপাকে ক্রেতা

ড. মিহির কুমার রায়
১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:৪০

বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় কৃষিপণ্যের মূল্যের অযোক্তিক আচরণ নতুন নয় যা আমরা আগেও দেখেছি চালে, কাঁচা চামড়ায় ও মরিচে। এখন তা দেখা যাচ্ছে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে- যা এরই মধ্যে জনমনে অস্বস্তি তথা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে এবং দেশের খাদ্যের মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে।দেশের ভেতরে লাগামহীনভাবে পেঁয়াজের মূল্য বাড়বে কেন? বর্তমানে প্রতি কেজি ১০০ টাকার বেশি যা দিয়ে ২ কেজি চাল, ১ কেজি মুগ/মসুর ডাল ও ১/২ কেজি আপেল কেনা যায়।দেশে ১২ শতাংশ হারে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের চাহিদাও বাড়ছে ভোক্তার ক্রয়-ক্ষমতার বৃদ্ধির জন্য। পেঁয়াজের জন্য বাংলাদেশ ভারতের ওপর বেশি নির্ভরশীল বিশেষত: সমধর্মী পেঁয়াজের জাত, সুুবিধাজনক যাতায়াত ব্যবস্থা ও সহায়ক মূল্যের জন্য। আবার আমদানিকারক দেশ ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের আমদানির মাধ্যমে প্রবেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারত গত মার্চ মাসে তাদের পেয়াজ রপ্তানী বন্ধ ঘোষনা দেয়ায় পেয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয় যদিও পূর্বের যে ষ্টক বাজারে রয়েছে তা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল । নির্বাচনের আগে এই ধরনের পরিস্থিতি সরকারকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে তুলেছিল ।

বিজ্ঞাপন

সারাবছরই মসলা জাতীয় এই শস্যটির একটি চাহিদা থাকে খাদ্য উপকরণে যদিও পেঁয়াজের একটি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে যেমন পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে, ক্যালসিয়াম- সালফার- ভিটামিন সংযোজনে, শরীরের তাপমাত্রা কমাতে, লিভারের হজম শক্তি বাড়াতে, ত্বকের সমস্যা নিরসনে, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে । কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিগত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে বছরে ২৪ লাখ টন। আবার উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ (প্রায় ৩০ শতাংশের মতো) বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয় বিধায় মোট ঘাটতি ৮ থেকে ৯ লাখ টন থেকেই যায় যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়, প্রতি বছরই যা স্বাভাবিক নিয়ম এবং আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে আমদানী ও উৎপাদন মিলিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৩৪ লাখ টন।। দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন এবং প্রতিদিন সারাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন আর ঢাকা শহরেই চাহিদা প্রতিদিন দেড় হাজার টন। সাধারণভাবে তিন ঋতুতে পেঁয়াজের চাষ হলেও বর্ষায় এর চাষ বেশি হয় যদিও বন্যার একটা অনিশ্চয়তা কিংবা বর্ষার একটি সঙ্কট রয়েই যায়। তারপরও যে বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়, সে বছর আবার কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং পরবর্তী বছরে পেঁয়াজ চাষে কৃষক আর উৎসাহিত না হয়ে অন্য ফসলে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায় পরবর্তী বছরে। বাজারে সাধারণত পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যেই উঠানামা করে থাকে । কিন্তু হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানীর বিষয়ে আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। কারণ একটি আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে গেলে তা প্রায় তিন সপ্তাহ লেগে যায়। এই পরিস্থিতিতে সুযোগ সন্ধানী উদ্যোগক্তাগণ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলে যা কৃষিপণ্যে বিপণনে খুবই লক্ষণীয়। তাই পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ ুকরেছিল যেমন পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ, স্থল/নদী বন্দরগুলোতে আমদানিকৃত পেঁয়াজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খালাসকরণে এনবিআর-এর পদক্ষেপ ইত্যাদি। একটি টক শো সুপারিশ করা হয়েছিল যে সারাদেশে কৃষিপণ্য মজুদের জন্য অত্যাধুনিক কোল্ড স্টোরেজ তৈরি হলে কৃষকের মূল্য ভোগান্তি আর ভোক্তার বেশি মূল্য পরিশোধের অশ্চিয়তা থাকবে না যা পিপিপির মাধ্যমে হতে পারে। তারপরও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বিশেষত: কৃষিজাত পণ্যের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরমার্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। দেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উগযোগী এবং বছরে ২ থেকে ৩ বার চাষ করার মতো উফশী জাতের বীজ রয়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষ, পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় ওয়্যার হাউস নির্মাণের কোন বিকল্প নেই। পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল যা দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে আর ৩০ শতাংশ নিয়ে জাতির চিন্তা। এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের ৩টি গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পেঁয়াজ এমন একটি মসলা জাতীয় ফসল যা পৃথিবীব্যাপী উৎপন্ন হয় এবং সব চাইতে বেশি উৎপাদন হয় ভারত ও চীন দেশে বিশেষত আদ্র অঞ্চলগুলোতে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম হয় আর হালকা শীত থাকে। আমদািন বাণিজ্যে আমদানিকারকদের সকল বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে, টিসিবির কার্যক্রম ভোক্তাবান্ধব হতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বাজার স্থিতিশীল হতে হবে, সঠিক নিয়মে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে মূল্য বিপর্যয়ের কোন সম্ভাবনা থাকবে না যা কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় হতে বাধ্য। সর্বোপরি পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মিহির কুমার রায় পেঁয়াজের উৎপাদন- বাজার মূল্য ও বিপাকে ক্রেতা মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর